কাপ্তাই পাল্পউড বাগান থেকে কাঠ পাচারের মহোৎসব

শান্তি রঞ্জন চাকমা, কাপ্তাই: কাপ্তাই পাল্পউড বাগান বিভাগের সংরক্ষিত বনাঞ্চল থেকে কাঠ পাচারের মহোৎসব চলছে। প্রতিদিন শতশত কাঠুরিয়া বনাঞ্চলে অবৈধভাবে প্রবেশ করে বাগান উজার করে ফেলছে। মাঠ পর্যায়ের বন বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ম্যানেজ করে আহরিত হাজার হাজার ঘনফুট কাঠ অন্যত্র পাচার করা হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এসব অবৈধ কাঠ পরিবহনে রাজস্থলী-চন্দ্রঘোনা, রাজস্থলী-দশমাইল-বান্দবান সড়ক হয়ে জীপ, মাইক্রো, ভটভটি ও ট্রাকযোগে এবং পাহাড়ি চোরাইপথে কান্দো পার্টির মাধ্যমে রাঙ্গুনিয়ার কোদালা, শিলক, সরফভাটা, বেতাগী চোরাই আড়তে মজুদ করা হয়। এসব কাঠ কর্ণফুলী নদীর রাঙ্গুনিয়া রেঞ্জের চিরিংগা চেক ষ্টেশন ও বিভিন্ন সড়ক হয়ে চট্টগ্রাম নগরীতে পাচার করা হচ্ছে বলে জানা গেছে।

কর্ণফুলী পেপার মিলস লি: (কেপিএম) কাগজ উৎপাদনের মুল উপকরণ পাল্পউড (নরম কাঠ) যোগান দিতে কাপ্তাই পাল্পউড বাগান বিভাগ সৃষ্টি করা হয়। পার্বত্য বান্দরবান জেলা ও রাঙ্গামাটি জেলার রাজস্থলী, কাপ্তাই এলাকায় পাল্পউড বাগান বিস্তৃত। কাপ্তাই পাল্পউড বাগান বিভাগের রাজস্থলী রেঞ্জ, হ্নাড়া রেঞ্জ, নোয়াপাতং রেঞ্জ, বাঘমারা রেঞ্জ, রাজভিলা রেঞ্জ, লিরাগাঁও রেঞ্জ, ধনু ছড়ি রেঞ্জ, রাইখালী রেঞ্জের বিশাল এলাকায় বিভিন্ন সময় পর্যায়ক্রমে কোটি কোটি চারা সৃজন করা হয়।

নাম প্রকাশে অনিশ্চুক এক বন কর্মকর্তা জানান, বন ও পরিবেশ মন্ত্রানালয় কর্তৃক কাপ্তাই পাল্পউড বাগান বিভাগে বনায়নের জন্য জলবায়ু ফান্ড থেকে কোটি কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়। রেঞ্জ ও বিটে বাগান সৃজনের নামে লক্ষ লক্ষ টাকা হরিলুট করার অভিযোগ উঠেছে। আবার কোথাও বাগান করা হলেও পরিচর্যা ও রক্ষণাবেক্ষনের অভাবে অনেক চারা নষ্ট হয়ে গেছে। পাল্পউড বাগান এলাকায় জুমচাষের আগুনে হাজার হাজার গাছ পুড়ে যায়। নোয়াপতং গ্রামের কৃষক মং থোয়াই মারমা বলেন, প্রতিদিন শতশত কাঠুরিয়া নোয়াপতং, ধনুছড়ি, বাঘমারা, হ্নাড়া, রাজস্থলী ও রাজভিলা রেঞ্জ সহ বিভিন্ন সরকারী বনাঞ্চলে প্রবেশ করে মূল্যবান সেগুন, আকাশমণি, জারুল, জাম, চাপালিশ, গামারি, কড়ই ও গর্জনসহ নানা প্রজাতির মূল্যবান বৃক্ষ নিধনে মেতে উঠেছে বনদস্যুরা। দিনে এসব গাছ কেটে রাতভর তা পাচার করা হয়। রাত যত গভীর হয় পাল্লা দিয়ে ততই বাড়তে থাকে কাঠ পাচারের উৎসব। সংরক্ষিত বনাঞ্চল থেকে প্রতি রাতে পাচার হচ্ছে লক্ষ লক্ষ টাকার কাঠ।

রাজভিলা গ্রামের এক স্কুল শিক্ষক বলেন, রাজভিলা ও বাঘমারা রেঞ্জ থেকে প্রতিদিন ৩০-৫০টি পরিবহন যোগে কাঠ পাচার হয়। পার্বত্য চট্টগ্রাম দক্ষিণ বন বিভাগের পারুয়া রেঞ্জের সংরক্ষিত বনাঞ্চল থেকে প্রতিদিন শতশত ঘনফুট চোরাই কাঠ রাজস্থলী রেঞ্জের আওতাধীন বিভিন্ন এলাকায় মজুদ করা হয়। এসব কাঠ রাজস্থলী চোরাইকাঠের আড়ত থেকে কান্দোপার্টির মাধ্যমে রাইখালী, চিৎমরম, কারিগড়পাড়া, নয়া রাস্তা মাথা, কোদালা গোপালপুরা হয়ে রাঙ্গুনিয়ায় পাচার করা হয়।

হ্নাড়া গ্রামের কিরন তংচংগ্যা বলেন, বিনাবাধায় কাঠ পাচার হওয়ায় কাপ্তাই পাল্পউড বাগান বিভাগের বনায়নকৃত বনায়ন বৃক্ষ শুণ্যে পরিণত হচ্ছে। সরকারি সংরক্ষিত বনাঞ্চল থেকে শুরু করে সামাজিক বনায়নও রেহাই পাচ্ছে না। পরিবেশবিদ ও স্থানীয় সচেতন মহলে মন্তব্য এ সব কাঠ অবৈধভাবে পাচারের সুযোগ থাকায় দ্রুত পরিবেশ নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। উজাড় হচ্ছে বনের গাছ ও বন্যপ্রানী পশুপাখি। পরিবেশ ও প্রকৃতি বন সংরক্ষনে যথাযত কঠোর পদক্ষেপ প্রয়োজন। জীপ চালক মোহাম্মদ করিম বলেন, বিশেষ টহল টিম (স্পেশাল টিম) ম্যানেজ করে রাজভিলা বনাঞ্চল থেকে জ্বালানি কাঠ স্থানীয় ব্রিকফিল্ডে সরবরাহ করা হচ্ছে।

বন বিভাগ সূত্র জানায়, কাপ্তাই পাল্পউড বাগান বিভাগে সহকারী বন সংরক্ষক (এসিএফ) ও রেঞ্জ কর্মকর্তা সংকট চলছে দীর্ঘদিন। রাজস্থলী সদর রেঞ্জ অফিস ছাড়া বাকী ৭টি রেঞ্জে ফরেষ্টার দিয়ে কার্যক্রম চলছে। বিশেষ টহল টিম (স্পেশাল টিম), নোয়াপতং রেঞ্জ ও বাঘমারা রেঞ্জ কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্বরত ফরেষ্টার মো. আব্দুল হাই বলেন, লোকবল সংকটের কারনে তিনটি রেঞ্জে দায়িত্ব পালনে হিমশিম খাচ্ছি। বিশাল এলাকা জুড়ে অপ্রতুল্য সংখ্যক বনকর্মী দিয়ে পুরোপুরি কাঠ পাচার রোধ সম্ভব নয়।

ফরেষ্টার মো. আনোয়ার হোসেন বলেন, কাঠ পাচার রোধে দিনরাত চেষ্ঠা চালিয়ে ফল পাচ্ছি না। দূর্গম পাহাড়ি এলাকায় স্বল্প সংখ্যক লোকবল দিয়ে বনায়ন রক্ষা করা সম্ভব নয়। আঞ্চলিক রাজনৈতিক কয়েকটি অস্ত্রধারী গ্রুপের আনাগোনা থাকায় নিজস্ব রেঞ্জে কাজ করা নিরাপত্তার ঝুঁকি রয়েছে। বাধ্য হয়ে রাজস্থলী উপজেলা সদরে ভাড়ায় অফিস নিয়ে পাল্পউডের সবকটি রেঞ্জের কাজ সম্পাদন করা হচ্ছে। হ্নাড়া রেঞ্জ কর্মকর্তা (ফরেষ্টার) মো. আজিজুল হক বলেন, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাঠ পাচার রোধে চেষ্ঠা চালিয়ে যাচ্ছি। বিশাল এলাকায় কম লোকবল দিয়ে শতভাগ কাঠ পাচার রোধ সম্ভব নয়। লোকবল বাড়ানো গেলে কাঠ পাচার কিছুটা কমে আসবে। কতিপয় বিট ও রেঞ্জ কর্মকর্তা দীর্ঘদিন একই উপজেলায় অবস্থানে নানা অনিয়মে লিপ্ত হচ্ছে দিনের পর দিন। এ সব অনিয়মকে নিয়মের পরিনত করে যে সমস্ত বন কর্মকর্তা জড়িত তাদেরকে অন্যত্র বদলি দাবী জানিয়েছে স্থানীয় সচেতন মহল।

রাজস্থলী রেঞ্জ কর্মকর্তা (ফরেষ্ট রেঞ্জার) মো. আব্দুল কাইয়ুম নিয়াজী বলেন, সবেমাত্র এ রেঞ্জে যোগদান করেছি। কাঠ পাচার বিষয়ে তদন্ত পূর্বক ব্যবস্থা নেয়া হবে। কাপ্তাই পাল্পউড বাগান বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) মো. রুহুল আমিন বলেন, ১ জন সহকারী বন সংরক্ষক ও ৭টি রেঞ্জ কর্মকর্তা পদে দীর্ঘদিন সংকট থাকার বিষয়ে উর্দ্ধতন মহলে লিখিত জানানো হয়েছে। অনিয়ম ও দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ বন কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।

Read Previous

লক্ষ্মীছড়ির বাইন্যাছোলায় সেনাবাহিনী উদ্যোগে চিকিৎসা সেবা

Read Next

মহালছড়িতে সাংগ্রাই উপলক্ষে মৈত্রী পানি খেলা