‘শিলং তীর’ জুয়ায় নিঃস্ব হচ্ছে রামগড়ের মানুষ

খাগড়াছড়ি প্রতিনিধি: ‘শিলং তীর’ সামাজিক অবক্ষয়ের আরেকটি ভয়াবহ জুয়ার নাম। সর্বস্ব লুটে নিয়ে ধিরে ধিরে নিঃস্ব করে দেয়া একটি মহামারি খেলা এই জুয়া। সম্প্রতি পুরো রামগড়ে ছড়িয়ে পড়েছে জুয়া নামক ব্যধিটির মারাতœক প্রকোপ। বেকার বা আড্ডাবাজ তরুন যুবকদের তার্গেট করে ভারতের শিলং হতে পরিচালিত ডিজিটাল জুয়া “শিলং তীর” খেলাটি পরিচালিত হচ্ছে।

সীমান্তবর্তী সিলেটের একেবারে কাছেই অবস্থান ভারতের মেঘালয় রাজ্যের রাজধানী শিলংয়ের। সিলেটের তামাবিল সীমান্ত পেরোলেই ওপারে শিলংয়ের পথ। শিলংয়ে জুয়াড়িদের মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় জুয়ার আসর হচ্ছে ‘তীর’। ১ থেকে ৯৯ পর্যন্ত সংখ্যাভিত্তিক এই জুয়া এখন মহামারি রূপে ছড়িয়ে পড়েছে রামগড় জুড়ে। এক শ্রেণীর দুষ্ট চক্র শুরুতে নির্দিষ্ট দুই একটি জায়গায় এ সর্বনাশা জুয়ার আসর বসলেও এখন তা ছড়িয়ে পড়েছে রামগড়ের শহর গ্রাম প্রতিটি এলাকাতেই। গত প্রায় দুই মাস ধরে প্রায় ১০টি স্পট এবং আশেপাশের বিভিন্ন উপজেলায়ও ছড়িয়ে পড়েছে ভয়ঙ্কর এই ‘শিলং তীর’ নামক জুয়ার আসর।

অনুসন্ধানে জানা যায়, ভারতের শিলং থেকে ‘শিলং তীর’ নামক জুয়া বছর কয়েক আগে সিলেটের সীমান্তবর্তী উপজেলা গোয়াইনঘাট ও কানাইঘাটে বিস্তার লাভ করে। এসব উপজেলা থেকে গত প্রায় দুই বছরে এ জুয়াটি মহামারি রূপে ছড়িয়ে পড়তে থাকে সিলেট মহানগরীসহ সারাদেশে। বর্তমানে এসব আসরে লাভের আশায় টাকা খরচ করা বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষরা সর্বশান্ত হয়ে ফিরেন। শুরুর দিকে সিলেট নগরীর বিমানবন্দর থানাধীন বড়শালা এলাকায় ‘শিলং তীর’র আসর বসতো। শুরুতে কৌশলী জুয়াড়িরা সাধারণ মানুষের আগ্রহ বাড়াতে দেদারসে জুয়ায় টাকা ঢালতে থাকে। এতে রিকশাচালক, দিনমজুর শ্রেণির মানুষদের ভিড় বাড়ে জুয়ার আসরে। ১০ টাকায় ৮০০ টাকা, ২০ টাকায় ১৬০০ টাকা তথা প্রতি টাকার বদলে ৮০ গুণ লাভ পেয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ে মানুষ। ‘শিলং তীর’ জুয়ার আসর সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানায়, মূলত এটি একটি কৌশলগত জুয়া। টাকা হাতিয়ে নেওয়ার একটি বিরাট ফাঁদ এটি। এ জুয়ার আসর থেকে সাধারণ মানুষ যাতে মুখ ফিরিয়ে না নেন, সেজন্য প্রতিদিনই কয়েকজনকে জুয়ার বাজিতে বিজয়ী ঘোষণা করা হয়। এসব জুয়ার আসরে রিকশাচালক, দিনমজুর, শিক্ষার্থী, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে জুয়ার নেশায় মত্ত বড় ব্যবসায়ীরাও টাকা ঢালছেন। হাতেগোণা কয়েকজন জুয়ার আসর থেকে হাসিমুখে ফিরলেও সিংহভাগই ফিরেন টাকা খুইয়ে।

 একটি চক বোর্ডে ১-১০০ ক্রমিকের সিরিয়াল আছে, সাথে আছে ১-৯ পর্যন্ত হাউজ আর এন্ডিং সংখ্যা। এর মাধ্যমে একজন জুয়ার গ্রাহক ১টি ঘরে সর্বনিম্ন ৫-সবোর্চ্চ  অনির্ধারিত টাকা পর্যন্ত একসাথে যতখুশি তত ঘরে জুয়ার বাজি ধরতে পারবেন। কিন্তু দিনশেষে ফলাফল আসবে মাত্র ১টি ঘরের। ১ থেকে ৯৯ সংখ্যাগুলোর মধ্যে যে নির্দিষ্ট সংখ্যায় বাজি ধরা হয়, সে সংখ্যা যদি বিজয়ী হয়, তবে বাজি ধরা ব্যক্তি নির্দিষ্ট টাকার ৮০ গুণ বেশি পান। অর্থাৎ, কেউ যদি এক হাজার টাকায় বাজি ধরে বিজয়ী হন, তবে তিনি পান ৮০ হাজার টাকা। বাজিতে প্রাপ্ত টাকার অংক কম হলে সাথে সাথেই পরিশোধ করা হয়। টাকার অংক বেশি হলে পরদিন তা পরিশোধ করা হয়। একই ব্যক্তি একাধিক সংখ্যা নিয়ে জুয়া খেলতে পারেন। আর সেখানে জুয়াড়ীরা যতটাকা বাজেট রাখবেন তার ৮০ গুন বেশী লাভ পাবেন। নির্ধারিত একটি ঘর বাদে বাকী ঘরের জুয়ার বাজেট চলে যাবে সোজা ভারতে জুয়ার প্রধান পয়েন্টে।

ভাবছেন কিভাবে সম্ভব? সীমান্তবর্তী রামগড়েই অন্তত ১০টি এজেন্ট পয়েন্ট রয়েছে শিলং’র, রামগড়ের গর্জনতলী, বল্টুরাম, কাশীবাড়ি, মুসলিম পাড়া, ছোট খেদা, পিলাক, মাষ্টারপাড়া, নাকাপা, দাতারামপাড়া, পাতাছড়া, মধুপুর, থলিপাড়া এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য এজেন্ট পয়েন্ট, এসব স্থানীয় এজেন্টরা ১ হাজার টাকার জুয়া বাজির কমিশন হিসেবে মুল কোম্পানীর কাছ থেকে পান ৬০টাকা। সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৩টা পর্যন্ত এসব এজেন্টের মাধ্যমে কাটা জুয়ার টাকা ও নাম্বার সাড়ে তিনটার মধ্যই পৌঁছে দিতে হবে রামগড়ের পাতাছড়া ইউপির দাঁতারাম পাড়ায় রামগড়ের প্রধান এজেন্টের কাছে। একটি নির্দিষ্ট সূত্রমতে, শুধুমাত্র রামগড় উপজেলাতেই শিলংএর দৈনিক কাউন্ট প্রায় ১২-১৫ লক্ষ টাকা আর ড্র আর আনুষাঙ্গিক ব্যায় প্রায় ২-৪লক্ষ টাকা। বাকি টাকা তাদের মুনাফা।  স্থানীয় একটি সূত্রমতে শিলং নামক জুয়া খেলায় বাধাঁ দেওয়ায় গতমাসে পাতাছড়ার এক ইউপি সদস্য ও তার ছেলেকে বেদম মারধর করে হাসপাতালে পাঠায় উপজাতীয় জুয়াড়ীরা। এছাড়াও আজ এখানে তো কাল ওখানে, শিলং চালুর পর থেকেই উপজেলার সর্বত্র শুরু হয়েছে গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগীসহ যাবতীয় দ্রব্যাদি চুরির প্রকোপ।

এর মধ্যেই আরেকটি চক্র অধিক মুনাফার লোভে নিজেরাই ভারতীয় শিলং’র আদলে রামগড়ে গড়ে তুলেছে নতুন আরেকটি শিলং। অসমর্থিত একটি সূত্রে জানা গেছে, একই কলাকৌশল ব্যবহার করে নাকাপা’র ১০ জন জুয়াড়ী ৫০ হাজার টাকা করে তহবিল করে মোট ৫ লক্ষ টাকা দিয়ে শুরু করেছেন শিলং’র জুয়া ব্যবসা। আর স্থানীয়দের মতে এতে জড়িত ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় প্রভাবশালী নেতারা। আর দেশী-বিদেশী জুয়াড়ীদের করাল গ্রাসে সর্বস্ব হারাচ্ছেন রামগড়বাসী। হতাশা আর মুক্তির চিন্তায় দিশেহারা স্থানীয় জনতা।  শিলংয়ের সাথে মিলিয়ে সপ্তাহে রবিবার ছাড়া বাকি ছয়দিনই এ জুয়ার আসর বসে। এছাড়া ভারতের রাষ্ট্রীয় ছুটির দিনে এ জুয়ার আসর বন্ধ থাকে। প্রতিদিন বিকাল ৫টায় জুয়ার ফলাফল ঘোষণা করা হয়।

অনুসন্ধানে জানা যায়, www.teercounter.com, (তীর কাউন্টার ডট কম) www.teerresults.com,, (তীর রেজাল্ট ডট কম) www.gravatar.com, www.meghalayateer.com,, (মেগালয়া তীর ডট কম) www.nightteer.com, (নাইট তীর ডট কম) www.teerresulttoday.com(তীর রেজাল্ট টুডে ডট কম) প্রভৃতি ওয়েবসাইটের মাধ্যমে ‘শিলং তীর’ সহ ইনন্টারনেটে পরিচালিত বিভিন্ন নামে এ জুয়ার জমজমাট আসর পরিচালিত হচ্ছে। ইনন্টানেটের মাধ্যমে মোবাইল বা কম্পিউটারের পরিচালিত এসব সাইট বাংলাদেশে বন্ধ করে দেওয়ার জন্য বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনকে (বিটিআরসি) পুলিশ চিঠি দিলেও এখনও কোন কাজ হয়নি ।

এদিকে স্থানীয়দের অভিযোগ প্রতিদিন লক্ষ লক্ষ টাকার জুয়ার আসর দিন দিন বৃদ্ধি পেলেও বরাবরই নিরব থাকছে স্থানিয় পুলিশ প্রশাসন। এ বিষয়ে জানতে চাইলে রামগড় থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) তারেক মোঃ আব্দুল হান্নান জানান, এ থানায় আমি নতুন এসে এ ব্যাপারে অবগত হয়েই একজন এসআইয়ের নেতৃত্বে অভিযান পরিচালনা করে শিলং তীর জুয়া খেলার কিছু আলমত জব্দ করি। জেলা মিটিংয়ে বিষয়টি নিয়ে উর্দ্বতন কতৃপক্ষের সাথে আলোচনা সাপেক্ষে যথাযথ আইনি প্রদক্ষেপ নেয়া হবে বলে তিনি জানান। তিনি আরো বলেন, এসব ডিজিটাল খেলা জনসচেতনতা ছাড়া বন্ধ করা সম্ভব নয় তবে যেসব ওয়েবসাইটের মাধ্যমে ‘শিলং তীর’ নামক জুয়া পরিচালনা করা হচ্ছে সেগুলো যদি বন্ধ করে দেওয়া সম্ভব হয়, তবে এ জুয়ার মহামারি কিছুটা হলেও রোধ করা সম্ভব হবে।

Read Previous

শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ‘র অভাবে ৩ পাবর্ত্য জেলায় পাঠদান ব্যহত ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠির মাতৃভাষার শিক্ষা

Read Next

সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে ফের উত্তাল সারা দেশ, শাহবাগে পুলিশের টিয়ারগ্যাস