খাগড়াছড়ি শহরে পুকুর ভরাট করে মার্কেট নির্মাণ,পরিবেশ মন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা

স্টাফ রিপোর্টার: ঐতিহ্যবাহী একটি পুকুর ভরাট করে সেখানে পৌর মার্কেট নির্মাণ শুরু করতে যাচ্ছে খাগড়াছড়ি পৌরসভা। আইনী জটিলতাসহ বিভিন্ন অভিযোগ উঠায় দীর্ঘ দু বছর ধরে নির্মাণ কাজ বন্ধ থাকার পর পুনরায় নির্মাণ কাজ শুরু করায় স্থানীয়দের মধ্যে উৎকন্ঠা দেখা দিয়েছে। জানা গেছে, ভূমি জালিয়াতির আশ্রয় নিয়ে পৌরসভা ৩০ শতক জমির (পুকুর) ওপর নতুন করে এই ভবন নির্মাণ করতে যাচ্ছে। এদিকে পুকুর ভরাট করে পৌর মার্কেট নির্মাণের প্রতিবাদে রাস্তায় নেমেছেন জেলার বিশিষ্ট নাগরিক ও পরিবেশ সংগঠনগুলো। তারা এ ব্যাপারে বন ও পরিবেশ মন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন। রবিবার শহরের শাপলা চত্বরে মানববন্ধন শেষে ৪ দফা সম্বলিত স্মারকলিপি দেয়া হয়।

২০১১ সালে মার্কেট উন্নয়নের নামে পৌরসভা মেয়রের নির্দেশে জগন্নাথ মন্দির সংলগ্ন ঐতিহ্যবাহী পুকুরটি ভরাট করা হয়। এরপর ২০১৫ সালে সেই পুকুরের ওপরই বিশ্ব ব্যাংকের প্রায় ৮ কোটি টাকায় বাংলাদেশ মিউনিসিপ্যাল ডেভলপমেন্ট ফান্ড (বিএমডিএফ) প্রকল্প গ্রহণ করে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এই পুকুরটির মালিকানা নিয়ে খাগড়াছড়ি বাজার ফান্ড কর্তৃপক্ষ ও গোলাপ ফুল চৌধুরীর ছেলে রাপ্রুচাই চৌধুরীর সাথে উচ্চ আদালতে (হাইকোর্ট) গত ১৬ বছর ধরে মামলা বিচারাধীন রয়েছে। আগামী কিছুদিনের মধ্যে শুনানীর কথা রয়েছে। এ ব্যাপারে আদালতের স্থিতাদেশও রয়েছে। কিন্তু তা অগ্রাহ্য করে পৌরসভার মেয়র রফিকুল আলম পুকুর ভরাট করে স্থাপনা নির্মানের কাজ অব্যাহত রাখেন।

এ ব্যাপারে পুকুরের মালিকানা দাবিদার খাগড়াছড়ি বাজার ফান্ড প্রশাসক ও পার্বত্য জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান কংজরী চৌধুরী জানান, মেয়র রফিকুল আলম গায়ের জোরে পুকুরটি দখল ও ভরাট করে এখন ভবন নির্মান করছেন। পুকুরের ওপর যে কোন ধরণের অবকাঠামো নির্মাণ থেকে বিরত থাকার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে অনুরোধ করেন।

জানা গেছে, বিএমডিএফ এর অর্থায়নে বাস্তবায়নাধীন পৌর মার্কেট নির্মান স্থানের জমির মালিকানা সম্পর্কিত বিবাদ মিমাংসা সংক্রান্ত সভায় অংশ নিতে সংস্থাটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সৈয়দ হাসিনুর রহমান খাগড়াছড়ি এসেছেন। এই রিপোটৃ লেখা পর্যন্ত সোমবার দুপুরে বৈঠকটি চলছিল। তবে, এ ব্যাপারে বক্তব্য নেয়ার জন্য কোনভাবেই বিএমডিএফ এর এমডি‘র সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।
পুকুরের আরেক মালিকানা দাবীদার মৃত গোলাপ ফুল চৌধুরীর ছেলে রাপ্রুচাই চৌধুরী জানান, ‘শোনা যাচ্ছে পুকুরের ওপর ফের ভবন নির্মানের কাজে বিএমডিএফ ও পৌরসভা হাত দিয়েছে। এত আপত্তির পরও পুকুরটিতে মার্কেট নির্মাণ করা হলে উচ্চ আদালতের কাছে বিচার বিভাগীয় তদন্ত চেয়ে আবেদন করা হবে।’ তবে এ সংক্রান্ত বৈঠকে অংশ নিতে তাকে অংশগ্রহণের জন্য বলা হলেও তাতে অংশ না নেয়ার কথা জানান তিনি। তিনি বলেন, মামলাটি মহামান্য হাইকোর্ট ডিবিশনে স্থিতাদেশ বহাল থাকায় এবং সহসাই শুনানীর অপেক্ষায় থাকায় এই সভায় অংশ নেয়া সম্ভব নয়।

খাগড়াছড়ি পরিবেশ সুরক্ষা আন্দোলনের সা: সম্পাদক সাংবাদিক আবু দাউদ জানান, শহরের পানির উৎসস্থল মাত্র ৩টি পুকুর। এর মধ্যে জগন্নাথ মন্দির পুকুরটি ভরাট করে মার্কেট নির্মাণের চেষ্টা চলছে। আর পানবাজার পুকুরে কফি হাউজ নির্মাণ করেছে পৌরসভা। অন্যদিকে মসজিদ পুকুরটিতেও বাণিজ্যিক স্থাপনা নির্মাণের পরিকল্পনা নেয়া হচ্ছে। এতে কোন পুকুরই আর অবশিষ্ট থাকবেনা এই শহরে। ফলে অগ্নিনিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে শহরবাসীর মধ্যে।

খাগড়াছড়ি প্রেসক্লাব সভাপতি আবু তাহের মুহাম্মদ জানান, জেলা পর্যায়ে পরিবেশ সুরক্ষা, নদী-ছড়া-খাল বেদখলমুক্ত রাখতে প্রতি মাসেই সংশ্লিষ্ট কমিটির সভা হয়। আলোচনাও হয়, কিন্তু সিদ্ধান্তগুলো আলোর মুখ দেখে না। ফলে কয়েক বছর পর পরই খাগড়াছড়ি শহরে ভয়াবহ জলাবদ্ধতা হচ্ছে। সম্পদহানি হচ্ছে।এই অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য এখনিই কার্যকর পদক্ষেপ সময়ের দাবি।

প্রকৌশলী নির্মল দাশ বলেন, উন্নয়নের অজুহাতে পুকুরগুলো ধংস করা হলে শহরের অগ্নি নিরাপত্তা বলতে কিছুই থাকবেনা। তিনি পুকুরগুলো সুরক্ষায় প্রশাসনের আশু পদক্ষেপ কামনা করেন। সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) এর সাধারণ সম্পাদক এডভোকেট নাসির উদ্দিন আহমেদ জানান, ‘এর আগেও পুকুরগুলো ভরাটের চেষ্টা করা হয়েছিল। জনআন্দোলনের মুখে জেলা পরিষদ বন্দোবস্তী বাতিলে বাধ্য হয়েছিল। এখনও পুকুর ভরাট ও স্থাপনা নির্মান করার কোন অধিকারই নেই পৌরসভার।’ তিনি পরিবেশ আইন অনুযায়ী ভরাটকৃত পুকুরটি পুন: খননের দাবী জানান।

খাগড়াছড়ির নারী অধিকার নেত্রী সেফালিকা ত্রিপুরা বলেন, ‘একটি পুকুর ভরাট করে সেখানে বিদেশী অর্থায়ন হলো কীসের বৈধতায়। পরিবেশগত ক্ষতি নিরুপণ ছাড়াই বিশ্বব্যাংকের মত একটি আন্তর্জাতিক সংস্থা এভাবে অর্থায়ন করতে পারেনা।’

খাগড়াছড়ি শহরের জগন্নাথ মন্দির সংলগ্ন বেদখল হওয়া ঐতিহ্যবাহী পুকুর পুনরুদ্ধার করে পুন:খননের দাবী জানানো হয়েছে। এই দাবিতে রোববার সকালে খাগড়াছড়ি শাপলা চত্বরে আয়োজিত মানববন্ধন ও প্রতিবাদ মিছিল থেকে এই দাবী জানিয়েছেন জেলার বিভিন্ন পরিবেশ সংগঠন ও বিশিষ্ট নাগরিকরা। একই সাথে বিএমডিএফ প্রকল্প বাতিলের দাবী করা হয়। কর্মসূচি থেকে শহরের পানবাজার পুকুর ও মসজিদ পুকুর সুরক্ষা এবং জেলার অন্যান্য পুকুর, ছড়া, খাল ও নদী বেদখল মুক্ত করার দাবী তোলা হয়। পরে জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে বন ও পরিবেশ মন্ত্রী বরাবরে স্মারকলিপি দেয়া হয়। মানববন্ধন চলাকালে বক্তব্য রাখেন অধ্যাপক মধুমঙ্গল চাকমা, খাগড়াছড়ি প্রেসক্লাবের সভাপতি জীতেন বড়–য়া, খাগড়াছড়ি সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি নুরুল আজম, এডভোকেট রতন কুমার দে, প্রকৌশলী নির্মল দাশ, নারীনেত্রী সেফালিকা ত্রিপুরা, খাগড়াছড়ি পরিবেশ সুরক্ষা আন্দোলনের সভাপতি প্রদীপ চৌধুরী, বেলা‘র নেটওয়ার্ক সদস্য আবু দাউদ প্রমূখ।

উল্লেখ্য যে, খাগড়াছড়ি পৌরসভা জগন্নাথ মন্দির সংলগ্ন পুকুর ভরাট করে পৌর মার্কেট নির্মাণ করার কাজ চলছে। কোন রকম পরিবেশগত ছাড়পত্র ছাড়াই বাংলাদেশ মিউনিসিপ্যাল ডেভলপমেন্ট ফান্ড (বিএমডিএফ) এর অর্থায়নে এই প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।

পাহাড়ের আলো

https://pahareralo.com

সর্বাধিক জনপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল। সর্বশেষ সংবাদ সবার আগে জানতে চোখ রাখুন পাহাড়ের আলোতে।

Related post