একজন রত্নগর্ভা মা খাগড়াছড়ির আনোয়ারা বেগম
জসিম উদ্দিন মজুমদার: খাগড়াছড়ি জেলার একজন রত্নাগর্ভা মা আনোয়ারা বেগম (৬০)। তিনি তাঁর সর্বোচ্চ চেষ্ঠা করে প্রতিষ্ঠিত করেছেন সন্তানদের। তাঁর অক্লান্ত পরিশ্রমে ছেলে-মেয়েদের মধ্যে একজন প্রবাসী, একজন পুলিশের সহকারী পুলিশ
সুপার, আরেকজন চিকিৎসক, দুইজন শিক্ষিকা এবং আরেকজন স্বাবলম্বী। আনোয়ারা বেগম নিজে হাইস্কুলের গন্ডি পেরোতে না পারলেও নিজের ছেলে মেয়েদের সেই গন্ডি ঠিকই পার করিয়েছেন। লেখা পড়া করিয়ে দু’সন্তানকে বিসিএস ক্যাডার বানাতে সক্ষম হয়েছেন। খাগড়াছড়ি শহরের কদমতলী এলাকার বাসিন্দা আনোয়ারা বেগমের সাথে কথা হয় তার বাসায়। তিনি জানান ১৯৬১ সালে তার জন্ম চট্টগ্রাম জেলার ভুজপুর থানার ভুজপুরে। তার বাবা মরহুম আহমেদ গণি সওদাগর ও মা জারিয়া খাতুনের খুব আদরের সন্তান ছিলেন। তিনি মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে ছিলেন। শিশুকালে তিনি ভুজপুর সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত এবং ভুজপুর হাইস্কুলে দশম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছিলেন। কিন্তু এসএসসি পরীক্ষা দিতে
পারেননি। তিনি মেধাবী ছাত্রী হলেও মুক্তিযুদ্ধসহ নানা কারণে হাইস্কুলের শিক্ষা কার্যক্রম শেষ করতে পারেননি। মাত্র ১৪ বছর বয়সেই তাকে বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হয়।
১৯৭৫ সালের ৫ মে তার বিয়ে হয়ে একই এলাকার বীর মুক্তিযোদ্ধা মোঃ শফিউল আলমের সাথে। বৈবাহিক জীবনে তিনি ৩ ছেলে ও ৩ মেয়ের জননী। বিয়ের পরে স্বামী শফিউল আলমের কোন কর্ম না থাকায় তিনি ১৯৮৫ সালে খাগড়াছড়ি কাঠ ব্যবসায়ী সমিতিতে অফিস সহকারী পদে চাকুরী নেন। কিন্তু স্বল্প বেতনে পরিবার চালানো কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ছিলো। পরে স্বামী শফিউল আলম ২২ অক্টোবর ১৯৯২ সালে যোগদান করেন খাগড়াছড়ি জেলা আইনজীবী সমিতির সিনিয়র আইনজীবী আলী নুরের সহকারী হিসেবে যোগদান করেন। তারপর থেকে এখনো তিনি একই জায়গা কাজ করছেন। তারপর স্বামীর ব্যস্ততার কারণে পুরো পরিবারকে ১৯৯৪ সালে খাগড়াছড়ি নিয়ে আসেন স্বামী শফিউল। তারপর শুরু হয় আসল যুদ্ধ। প্রথমে তার স্বামী তাদেরকে শান্তিনগরের অদুদ মেম্বারের বাসায় ভাড়াটিয়া হিসেবে উঠান। তখন ৬ ছেলে মেয়েকে নিয়ে চরম কষ্টে পড়েন। স্বামীর স্বল্প আয়ে ছেলেমেয়েদের ভরণ-পোষন ও শিক্ষা খরচ চালানো কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ে। নিজের ছেলে-মেয়েদের নিজে পড়ানোর পাশাপাশি কখনো-কখনো প্রাইভেট টিচার দিয়েও পড়াতেন। শিক্ষার খরচ ও কাপড়-চোপড়ের খরচ চালাতে অনেক সময় জমানো চাল বিক্রি ও গহণা বিক্রি করতে হয়েছে। দীর্ঘ ১০ বছর যাবত খাগড়াছড়ি শহরের বিভিন্ন স্থানে ভাড়া বাসায় থাকতে হয়েছে। ভাড়া বাসায় থাকা কত কষ্টকর তা যারা ভাড়াটিয়া হিসেবে আছেন, তারাই বলতে পারবেন। দীর্ঘ ১০ বছর পরে খাগড়াছড়ি শহরের কদমতলী এলাকায় ৫শতক জায়গা ক্রয় করে ঘর করে স্থায়ীভাবে মাথা-গোঁজার ঠাঁই হয়েছে।
বর্তমানে তার বড় ছেলে কামরুল হাসান প্রবাসী, তার মেয়ে তাহমিনা আক্তার কুমিল্লার দৌলতপুরের সম্ভ্রান্ত এক মুসলিম পরিবারের গৃহবধু, মেয়ে রুবিনা আকতার ও তানজিলা আক্তার দু’টি সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষিকা, ছেলে ইমরুল হাসান বর্তমানে সহকারী পুলিশ সুপার হিসেবে কর্মরত আছেন কুমিল্লা জেলার সদর (দক্ষিণ) সার্কেলে এবং ছোট ছেলে ডাঃ ফকরুল হাসান চিকিৎসক হিসেবে কর্মরত আছেন ঢাকাস্থ বঙ্গবন্ধু মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। আনোয়ারা বেগম জানান, সব সময় নামাজ পড়ে আল্লাহর নিকট সন্তানদের কল্যান কামনায় দোয়া করতাম। আল্লাহ আমার ৬ ছেলে মেয়েকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন, তার ভালো আছে, সুখে-শান্তিতে আছেন এবং মানব-সেবায় কাজ করছেন এই জন্য আল্লাহর নিকট শুকরিয়া জ্ঞাপন করছি।
স্বামী শফিউল আলম বলেন ১৯৭৫ সাল হতে স্ত্রী আনোয়ারা বেগম আমার জীবনে আলো হয়ে এসেছে। আমার পরিবারের সকল সুখ-আনন্দ-স্বাচ্ছন্দের-উন্নয়নের পিছনে অবদান আমার স্ত্রীর। আমার সন্তানদের আজকের প্রতিষ্ঠিত হবার পিছনে আমার স্ত্রীর অবদান।
ডাঃ ফখরুল হাসান মায়ের কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে বলেন মায়ের ঋণ কখনো শোধ হবে না। বিশ^ মা দিবসে মায়ের জন্য ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা জানান তিনি। কুমিল্লা (সদর দক্ষিণ) পুলিশের সহকারী পুলিশ সুপার ইমরুল হাসান বলেন আমিসহ আমার ভাইবোনদের আজকের এই অবস্থানের পিছনে আমার মায়ের অবদান সবচেয়ে বেশি। বাবা আর্থিক যোগান দিলেও আমার মা অর্থমন্ত্রীর মতো সেই টাকা বিভিন্ন খাতে সঠিকভাবে ব্যায় করে আমাদেরকে বিসিএস ক্যাডার বানিয়েছেন। মায়ের পাশাপাশি বাবার কাছেও কৃতজ্ঞতা জানান পুলিশের এই কর্মকর্তা।
খাগড়াছড়ি পৌরসভার মেয়র নির্মলেন্দু চৌধুরী রত্নাগর্ভা মা আনোয়ারা বেগমকে স্যালুট জানিয়ে বলেন এই ধরণের মা প্রতি ঘরে ঘরে থাকলে পরিবার-সমাজ ও রাষ্ট্র আরো আলোকিত হবে। দেশের উন্নয়ন হবে। দেশ এগিয়ে যাবে।