এক দশকে হারিয়েছে খাগড়াছড়িতে শতাধিক পাহাড়
খাগড়াছড়িতে পাহাড় কাটছে প্রভাবশালীরা, প্রশাসনের নজরদারির অভাবে এখানে বিলীন হচ্ছে অনেক পাহাড়
॥ জসিম উদ্দিন মজুমদার ॥
খাগড়াছড়ি জেলার ৯ উপজেলায় গত এক দশকে হারিয়ে গেছে শতাধিক পাহাড়। শক্ত আইন থাকলেও প্রশাসনের নজরদারির অভাবে এসব পাহাড় কেটে জায়গা সমতল করা হয়েছে। এখনও অব্যাহত রয়েছে জেলার বিভিন্ন এলাকায় প্রভাবশালীদের পাহাড় কাটা। এর ফলে পরিবেশ যেমন বিপর্যস্ত হচ্ছে, তেমনি কমছে জঙ্গল, পশু-পাখি হারাচ্ছে আবাসস্থল। পরিবেশকর্মীরা বারবার বিষয়টি প্রশাসনের নজরে এনে পাহাড় কাটা বন্ধের আহ্বান জানালেও এ বিষয়ে নিয়মিত অভিযান ও নজরদারি নেই প্রশাসনের। মাঝে মাঝে দু’একবার অভিযান চালিয়ে, দু’চারজনকে জেল-জরিমানা করেই নিজেদের কাজ শেষ করছে প্রশাসন। তবে পরিবেশকর্মীদের আশঙ্কা, এভাবে পাহাড় কাটা চলমান থাকলে পার্বত্য এলাকা হিসেবে হারিয়ে যাবে খাগড়াছড়ির সুনাম, আরও হুমকির মুখে পড়বে পরিবেশ।
স্থানীয় পরিবেশকর্মী ও প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, গত এক দশকে জেলার রামগড় উপজেলার নজির টিলা, নাকাপা, দাতারামপাড়া, বল্টুরামটিলা, খাগড়াবিলসহ বিভিন্ন এলাকায় প্রায় ১৫টি বড় পাহাড় কেটে সমতল করে ফেলা হয়েছে। একইভাবে মানিকছড়ি উপজেলার গচ্ছাবিল, হাজীপাড়া, মুসলিমপাড়া, গাড়িটানাসহ বিভিন্ন এলাকায় ১০ থেকে ১৫টি পাহাড়, গুইমারা উপজেলায় সরকারি হাইস্কুল সংলগ্ন বড়পিলাক, হাফছড়ি, কালাপানি, রামছু বাজার, জালিয়াপাড়া, সিন্দুকছড়ি এলাকায় প্রায় ১৩/১৪টি পাহাড়, মাটিরাঙা উপজেলায় গাজীনগর, মুসলিমপাড়া, তবলছড়ি, বেলছড়ি, মোহাম্মদপুর, পলাশপুর, করল্যাছড়ি, বলিটিলা, নবীনগরসহ বিভিন্ন এলাকায় ২৫ থেকে ৩০টি, পানছড়ি উপজেলায় উল্টাছড়ি, ফাতেমা নগরসহ বিভিন্ন এলাকায় ৬ থেকে ৭টি, মহালছড়ি উপজেলায় চোংড়াছড়ি, ক্যায়াংঘাট, শান্তিনগর, ব্যাটালিয়ন এলাকা সংলগ্ন এলাকায় ৮ থেকে ৯টি, দিঘীনালা উপজেলার মধ্য বোয়ালখালী, কাঁঠালতলী, রশিকনগর, বটতলী, শনখোলা ব্রিক ফিল্ড, মধ্য বেতছড়ি, চোংড়াছড়ি, বিবাড়িয়া পাড়া, বাছামেরুং, বড় মেরুং হেডকোয়ার্টার, গোলামআলী টাইগার টিলা এলাকায় প্রায় ১৫টি এবং খাগড়াছড়ি সদরের শালবাগান, রসুলপুর, কুমিল্লাটিলা, সবুজবাগ, ভুয়াছড়ি, নতুন পাড়া, মুক্তিযোদ্ধা পল্লি, দাতকুপিয়া এলাকায় প্রায় ১২টি দৃশ্যমান পাহাড় কেটে সমতল করা হয়েছে। খাগড়াছড়িতে প্রভাবশালীরা বড় বড় যন্ত্র লাগিয়ে অবাধে পাহাড় কেটে নিলেও অভিযোগ রয়েছে, বেশিরভাগেরই খবর রাখে না প্রশাসন।
বেশিরভাগ পাহাড় কেটে ঘরবাড়ি, দোকান পাট ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয়েছে। এক তৃতীয়াংশ পাহাড় কেটে বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হলেও বাকি দুই-তৃতীয়াংশে বসতবাড়ি নির্মাণ করা হয়েছে। এছাড়া সরকারি বিভিন্ন স্থাপনা ও রাস্তাঘাট নির্মাণে নির্বিচারে কাটা হয়েছে পাহাড়। বিভিন্ন সময় প্রশাসনের পক্ষ হতে অভিযান চালিয়ে, মোবাইল কোট বসিয়ে একাধিক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে জেল ও জরিমানা করা হয়েছে। সর্বশেষ চলতি মাসের প্রথম দিকে মানিকছড়ি গাড়িটানা এলাকায় এক প্রতিষ্ঠানকে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে।
খাগড়াছড়িতে পাহাড় যে শুধু প্রভাবশালীরাই কাটছে তা কিন্তু নয়। সেখানে গত ৩০ বছরের মধ্যে স্থায়ী হওয়া সমতল ভূমি থেকে যাওয়া বাঙালিদের বিরুদ্ধেই এ বিষয়ে অভিযোগ বেশি। এরমধ্যে বিভিন্ন শ্রেণির জমি লিজ নেওয়া শ্রমজীবী বাঙালিরা তাদের বাগান, ক্ষেত, মাঠ, দোকান পাট ইত্যাদির সুবিধার জন্য অবাধে পাহাড় কাটছে। গত ৪ নভেম্বর এমনই একটি অভিযোগ দায়ের হয়েছে পানছড়ি থানায়। পার্বত্য জেলার পানছড়ির ৫নং উল্টাছড়ি ইউপির আলীনগর এলাকায় পাহাড় কাটার কারণে প্রতিবেশীর দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে থানায় নালিশ করেছেন মোশারফ হোসেন নামে এক বাগান মালিক। এখানে নুরুল ইসলাম নামে এক ব্যক্তি পাহাড়ের মাটি কেটে ছড়ায় বাঁধ দেওয়ায় পানছড়ি থানায় অভিযোগ দাখিল করেছেন তার প্রতিবেশী মোশারফ। গত ৪ নভেম্বর ৬ জনের নাম উল্লেখ করে তিনি এ অভিযোগ দাখিল করেন।
অভিযোগে জানা যায়, বাগান মালিক মোশারফ হোসেন ২৪৬নং ছোট পানছড়ি মৌজায় ক্রয়সূত্রে খাস ১ একর ২০ শতক ৩য় শ্রেণির ভূমিতে সেগুন ও আম বাগান করেন। তবে এ ভূমির পাশের বাসিন্দা নুরুল ইসলাম ও সাহাব উদ্দিন প্রশাসনের বিনা অনুমতিতে পাহাড় কেটে চলমান ছড়ায় বাঁধ দিয়েছেন। এতে ছড়ায় পানি জমে সৃজনকৃত বাগান ভেঙে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে ও ভূমিধসে পরিবেশের বিপর্যয়ের আশঙ্কাসহ তার ভূমির অপূরণীয় ক্ষতির আশঙ্কা রয়েছে বলে মোশারফ অভিযোগ করেছেন। তার দাবি, বাঁধ নির্মাণে বাধা দেওয়ায় তাকে প্রাণনাশের হুমকি দেওয়া হয়েছে।
এ বিষয়ে অভিযুক্ত নুরুল ইসলাম বলেন, আমার জায়গায় আমি মাটি কাটছি ঘর করার জন্য, এতে মোশারফের বাগানের কোনও ক্ষতি হবে না। মোশারফের বাগান পুকুর পাড় থেকে অনেক দূরে। এছাড়া আমার ছেলে শরীফকে অভিযুক্ত করা হয়েছে অথচ শরীফ দীর্ঘদিন যাবৎ ঢাকায় অবস্থান করছে।
তবে পাহাড় কাটায় কঠোর ব্যবস্থার বদলে সালিশ বৈঠকের দিকে যাচ্ছে পুলিশ। এ বিষয়ে পানছড়ি থানার এএসআই নুরুল আলম বলেন, অভিযোগ পেয়েছি এবং ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছি। আগামীকাল উভয়পক্ষকে গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ ও নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদেরকে নিয়ে থানায় আসতে বলেছি বিস্তারিত শুনে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এমন সালিশ বৈঠক করে আদৌ পাহাড় বাঁচানো যাবে কিনা সে বিষয়ে রয়েছে সচেতনদের নানা প্রশ্ন।
খাগড়াছড়ি পরিবশে সুরক্ষা আন্দোলনের সভাপতি প্রদীপ চৌধুরী বলেন, খাগড়াছড়িতে পাহাড় বাঁচানোর জন্য তারা দীর্ঘ সময় আন্দোলন করে আসছেন। খাগড়াছড়ির প্রায় সাড়ে ১৩শ’ গ্রামের প্রায় হাজার খানেক গ্রামেই পাহাড় আছে এবং লোকজন বিভিন্ন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও বসত ঘর করেছে পাহাড় কেটে সমান করে। জেলায় প্রায় ৫০টি ব্রিক ফিল্ডের সব কটিতেই পাহাড় কাটা মাটি ইট তৈরিতে ব্যবহার হচ্ছে। প্রশাসনের শক্ত নজরদারির পাশাপাশি তিনি জেলায় পরিবেশ অধিদফতরের অফিস স্থাপনের দাবি জানান।
বাংলাদেশ এনভায়রনমেন্ট ল ইয়ারস অ্যাসোসিয়েশন (বেলা) খাগড়াছড়ি জেলা শাখার সদস্য মুহাম্মদ আবু দাউদ বলেন, খাগড়াছড়িতে ক্রমাগত পাহাড় কাটার কারণে বর্ষাকালে অনেক পাহাড় ধসে খাল বিল ভরে যাচ্ছে, পাহাড় ধসে ঘরবাড়িতে পড়ে জীবন ও সম্পদ নষ্ট হচ্ছে, পরিবেশ ও প্রাণিকুল নষ্ট হচ্ছে। এক কথায় জীববৈচিত্র্য নষ্ট হচ্ছে। এই অবস্থা থেকে রক্ষা পেতে পাহাড় রক্ষা করতেই হবে। এজন্য দরকার প্রশাসনের শক্ত হস্তক্ষেপ।
জেলা প্রশাসক প্রতাপ চন্দ্র বিশ্বাস বলেন, পাহাড় কাটা-বালু উত্তোলন করাসহ পরিবেশ বিধ্বংসী সকল কাজের বিরুদ্ধে সোচ্চার জেলা প্রশাসন। পাহাড় কাটার বিরুদ্ধে ৯ উপজেলা নির্বাহী অফিসার কার্যকরী ব্যবস্থা নিচ্ছেন। তারা মোবাইল কোর্ট পরিচালনার মাধ্যমে পাহাড় কাটায় জড়িতদের জেল দিচ্ছে, জরিমানা করছে। পাশাপাশি যেসব যন্ত্রপাতি ও যানবাহন পরিবেশ বিধ্বংসী কাজে ব্যবহার হচ্ছে তা জব্দ করে রাষ্ট্রের হেফাজতে নেওয়া হচ্ছে। যত বড় প্রভাবশালী হোক পাহাড় কাটলে কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না। পাহাড় কাটার সংবাদ প্রশাসনকে জানিয়ে সহযোগিতার জন্য মিডিয়াকর্মীসহ সকলের সহযোগিতা প্রত্যাশা করেন তিনি।