• October 24, 2024

‘করোনা’ মহামারীতে অনলাইন স্কুল খুলে অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন রুপা মল্লিক ও পরশ মাহমুদ

মোবারক হোসেন: বৈশ্বিক মহামারী ‘করোনা’ ভাইরাস’র ভয়াল থাবায় স্থবির হয়ে পরেছে সকল কার্যক্রম। মানুষের মৌলিক চাহিদার অন্যতম হলো শিক্ষা। করোনা ভাইরাসের বিস্তৃতিরোধ করতে সরকার বন্ধ রেখেছে সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। সরকার সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে। অঘোষিত লকডাউনে মানুষ অনেকটাই ঘর বন্দী। বদলে গেছে মানুষের জীনধারা। শিশুদের জীবনে এসেছে বৈচিত্রময় এক পরিবেশ। যে শিশুটি সকালে নাস্তা করে স্কুলে যাওয়ার কথা, যে শিশুটি স্কুল থেকে ফিরে খেলা-ধুলা করার কথা। কিন্তু অদৃশ্য প্রাণঘাতী করোনায় পাল্টে দিয়েছে সব কিছু। চার দেয়াল কিংবা বাড়ির বাহিরে যাওয়া মা-বাবার রয়েছে নিষেধাজ্ঞা।

এই যখন পরিস্থিতি কর্মহীন হয়ে পরা মানুষের জন্য দেয়া হচ্ছে ত্রাণ, অসুস্থ্য রোগীদের জন্য দেয়া হচ্ছে চিকিৎসা। এমনিভাবে মানবতার সেবা সরকারি- বেসরকারি প্রতিষ্ঠান নানা ভাবে কাজ করছে। কিন্তু যারা মানুষ গড়ার কারিগড় তারা কি আর ঘরে বসে থাকতে পারে। তেমনি দু’জন শিক্ষক ডিজিটাল সেবার সুযোগ নিয়ে খাগড়াছড়িতে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের শ্রেণী কার্যক্রম এগিয়ে নিতে চালু করেছে ‘অনলাইন স্কুল’। খাগড়াছড়ি অনলাইন স্কুল চালু করে এমনি বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন শিক্ষক রুপা মল্লিক ও মো: পরশ মামুদ।

রুপা মল্লিক(রুপু) খাগড়াছড়ি জেলা সদর টিএন্ডটি গেইট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারি শিক্ষিকা এবং মো: পরশ মামুদ(শিমুল) লক্ষ্মীছড়ির জারুলছড়ি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে কর্মরত। এই দু’জনে মিলে চালু করেন খাগড়াছড়ি অনলাইন স্কুল। ধীরে ধীরে জনপ্রিয় হয়ে ওঠছে খাগড়াছড়ি অনলাইন স্কুল।

কিভাবে শুরু হলো খাগড়াছড়ি অনলাইন স্কুল: ২০১৯ সালের ১২ জুলাই ১ম বারের মত শিক্ষক বাতায়নে সপ্তাহের সেরা কন্টেন্ট নির্মাতা হিসেবে নির্বাচিত হই, এরপর ২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৯ ২য় বারের মত সপ্তাহের কন্টেন্ট নির্মাতা হবার গৌরব অর্জন করি। এরপর Ict4e জেলা এম্বাসেডর হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছি। এসব কথাগুলোই বলছিলেন, খাগড়াছড়ি টিএন্ডটি গেইট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারি শিক্ষিকা রুপা মল্লিক। তিনি বলেন, করোনা মহামারির কারণে গত ১৮ মার্চ থেকে বিদ্যালয় বন্ধ হয়ে যায়। এরপর দেশের ক’জন গুণী শিক্ষকের সাথে যোগাযোগ করে গত ১৮এপ্রিল থেকে আমি ময়মনসিংহ অনলাইন স্কুলের মাধ্যমে আমার অনলাইন ক্লাস শুরু করি। এরপর ‘বাংলাদেশ আলোকিত প্রাথমিক শিক্ষক’ -ঢাকাতে ২১এপ্রিল এ ক্লাস নিই। এরপর ২৪এপ্রিল থেকে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর ও ধ২র হতে পরিচালিত ঘরে বসে শিখি অনলাইন পেইজে ক্লাস নেওয়া শুরু করি, তারপর ৩ মে থেকে Chattogram Online School এ ক্লাস নিই, ৮মে থেকে Teacher’s Dream এ ক্লাস নেওয়া শুরু করি, Dinajpur Online Primary School এ ক্লাস নেওয়া শুরু করি ৩মার্চ থেকে। এরপর লক্ষীছড়ির জারুলছড়ি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় এর শিক্ষক ও Ict4e জেলা এম্বাসেডর এবং বাতায়নের সপ্তাহের সেরা কন্টেন্ট নির্মাতা পরশ মামুদ স্যারসহ খাগড়াছড়ি অনলাইন স্কুল খোলার সিদ্ধান্ত নিই এবং পেইজ খুলে জেলার অন্যান্য এম্বাসেডর শিক্ষকদেরকে এই গ্রুপে আমন্ত্রণ জানাই। তারাও স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে সাড়া দেন। ২৩ মে থেকে আমরা শ্রেণি কার্যক্রম শুরু করি। ২০১৯ সালে খাগড়াছড়ি সদর উপজেলার শ্রেষ্ঠ সহকারি শিক্ষক নির্বাচিত এবং ২০২০ ct4e জেলা এম্বাসেডর মনোনীত হওয়া রুপা মল্লিক বলেন, আমি আশা করি এর মাধ্যমে আমি আমার জেলাকে নিয়ে এই দুর্যোগ মুহুর্তে যে স্বপ্ন দেখেছি তা সফল হবে ইনশাল্লাহ।

কথা হয় জারুলছড়ি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়সহকারি শিক্ষক মোঃ পরশ মামুদ’র সাথে। একজন আইসিটি প্রেমী মানুষ। ২০১৮ সালে খাগড়াছড়ি পিটিআই থেকে আইসিটি ট্রেনিং পাওয়ার পর তার আইসিটিতে কাজের আগ্রহ বহুগুণে বেড়ে যায়। শিক্ষক বাতায়ন, মুক্তপাঠ, মাইক্রোসফট এডুকেটর, মাল্টিমিডিয়া ক্লাস পরিচালনাসহ বিভিন্ন স্থানে কাজ করতে থাকেন তিনি। তাঁর কাজের স্মীকৃতি হিসেবে ২০১৮ সালেই ১০আগস্ট খাগড়াছড়ি জেলার প্রাথমিক শিক্ষকদের মধ্যে সর্বপ্রথম প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে পরিচালিত a2i থেকে ICT4E District Ambassador হিসেবে নিয়োগ পান। এখানেই থেমে থাকেনি তার কাজ। খাগড়াছড়ি জেলার বিভিন্ন উপজেলায় ঘুরে ঘুরে বিভিন্ন শিক্ষকগণের সাথে আলোচনা করেন কিভাবে মাল্টিমিডিয়া ক্লাস পরিচালনা করবেন, নানা রকম সমস্যা সমাধান করে দেন, শিক্ষক বাতায়ন, মুক্তপাঠসহ আইসিটিকে প্রচার ও প্রসার করতে থাকেন। ২০১৯ সাথের ২৪শে মে আবারও তিনি খাগড়াছড়ি জেলার প্রথম সপ্তাহ সেরা কন্টেন্ট নির্মাতা নির্বাচিত হন। খাগড়াছড়ি বর্তমানে প্রাথমিক এর ১১ জন ICT4E District Ambassador. তিনি সুধু জেলাতেই আইসিটি ম্যান হিসেবে পরিচিত তাই নয়, তিনি সারা দেশের সকল আইসিটি শিক্ষকদের এক পরিচিত মুখ।

চলতি বছর ১৭ মার্চ থেকে সারা দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হওয়ার পর থেকেই প্রাথমিক অধিদপ্তর ও a2i মিলিতভাবে ঘরে বসে শিখি পেইজে সহ দেশের প্রায় ১৫-২০ টিরও বেশি অনলাইন স্কুলে ক্লাস করে আসছিলেন। খাগড়াছড়ি রুপা মল্লিক রুপু’র সাথে পরামর্শ করে এই খাগড়াছড়ি অনলাইন স্কুলের যাত্রা শুরু করেন বলে জানান তিনি।

জানা যায়, প্রতিদিনি সকাল সাড়ে ৯টা থেকে দুপুর সাড়ে ১২টা পর্যন্ত অনলাইনে ১ম শ্রেণী থেকে ৫ম শ্রেণী পর্যন্ত সকল বিষয়ে ক্লাশ চলে। মোট ৩০জন শিক্ষক এ কাজে নিয়োজিত রয়েছে।

অনলাইনে ক্লাশ দেখেন লক্ষ্মীছড়ি মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ৫ম শ্রেণীর ছাত্রী মারুফা ফারজানা। এই শিক্ষার্থী বলছিল এভাবেই, আব্বা-মা তো বাহিরে যেতে দেয় না। তাই ঘরে বসে টিভি দেখি। অনলাইনে ক্লাশ দেখে ভালো লাগে। চাঁদপুর কচুয়া থেকে ক্ষুদে বার্তায় ৪র্থ শ্রেণীর শিক্ষার্থী ফাতেমা ওমর জানালো আমি নিয়মিত খাগড়াছড়ি অনলাইন স্কুল পেইজে যুক্ত থাকি। এর মাধ্যমে অনেক কিছউ শিখতে পারছি। রুপা মেম’র সাথে ফেইসবুক ম্যাজেঞ্জারেও যোগাযোগ রেখে আমার খাটতিটুকু পূরণ করে নেই। অভিভাবক আসমা আক্তার বলেন, স্কুল বন্ধ মানে ছেলে-মেয়েরা সহজে ঘরে পড়তেও বসতে চায় না, এ অবস্থায় অনলাইন স্কুল পড়া-শোনার জন্য বাড়তি একটা সুযোগ করে দিয়েছে। আমি মনে করি, খাগড়াছড়ি অনলাইন স্কুলের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা শ্রেণী পাঠ সম্পর্কে যতটকু জানতে পারছে সে জন্য যারা এ উদ্যোগ নিয়েছেন তাঁদের ধন্যবাদ জানাই।

খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান কংজুরী চৌধরী ও জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার’র প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন খাগড়াছড়ি অনলাইন স্কুলের এডমিন ও পরিচালক মোঃ পরশ মামুদ ও রুপা মল্লিক। খাগড়াছড়ি সকল প্রাথমিক শিক্ষকদের পক্ষ থেকে আন্তরিক ধন্যবাদ জ্ঞাপন করে খাগড়াছড়ির সর্ব স্তরের জনগণকে এই পেইজকে লাইক, ক্লাস সমূহকে শেয়ার, কমেন্ট করে বহুল প্রচারের জন্য অনুরোধ করেন।

খাগড়াছড়ি জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার: খাগড়াছড়ি জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার ফাতেমা মেহের ইয়াসমিন শিক্ষকদের এ নিজস্ব উদ্যোগ প্রশংসার দাবি রাখে উল্লেখ করে বলেন, এই দুর্যোগ মুহুর্তে শিক্ষকরা ছেলে-মেয়েদের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে শিক্ষা ব্যবস্থা চালু রাখতে খাগড়াছড়ি অনলাইন স্কুল চালু করার ফলে শিক্ষার্থীরা শ্রেণী পাঠ সম্পর্কে ধারনা নিতে পারছেন। এই পরিস্থিতি যত দিন থাকে স্কুল না খোলা পর্যন্ত শিক্ষকদের এ কার্যক্রম চালু রাখার আহবান জানান তিনি।

খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান কংজুরী চৌধরী: খাগড়াছড়ি জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান কংজুরী চৌধুরী এক ভিডিও বার্তায় খাগড়াছড়ি অনলাইন স্কুলকে স্বাগত জানিয়ে বলেন, বর্তমান এই করোনাকালীন এই পরিস্থিতিতে সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ। বিশেষ করে এই খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলার কোমলমতি শিশুরা ক্লাস করতে পারছে না। তাদের কাছে অনলাইনে ক্লাস পৌঁছে দেবার জন্য এক দল উদ্দ্যোমী শিক্ষক এই খাগড়াছড়ি খাগড়াছড়ি অনলাইন স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। তাদেরকে অভিনন্দন জানাই। এই খাগড়াছড়ি অনলাইন স্কুলের মাধ্যমে প্রত্যন্ত অঞ্চলের শিক্ষার্থীরা এই সুযোগ পাবে। তিনি জাতীয়ভাবে সংসদ টিভিতে প্রচারকৃত ক্লাস দেখারও আহবান জানান। তিনি আরও বলেন, খাগড়াছড়ি ক্যাবল নেটওয়ার্ক অপারেটরদের উদ্দেশ্যে করে বলেন, আপনারা এই খাগড়াছড়ি অনলাইন স্কুল পেইজের সাথে এক হয়ে আগামী প্রজন্মকে জাতীয়ভাবে শিক্ষিত করে তোলার লক্ষ্যে ক্লাস প্রচার করেন তাহলে এই খাগড়াছড়ি অনলাইন স্কুলের যে উদ্দ্যোগ আরও সফল হবে। তিনি খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদের পক্ষ থেকে সকল প্রকাশ সহযোগিতা করবেন বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন।

পাহাড়ের আলো

https://pahareralo.com

সর্বাধিক জনপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল। সর্বশেষ সংবাদ সবার আগে জানতে চোখ রাখুন পাহাড়ের আলোতে।

Related post