খাগড়াছড়ি প্রতিনিধি: পার্বত্য চট্টগ্রামকে সত্যিকার অর্থে উন্নয়নের মূলধারায় সম্পৃক্ত করতে হলে সেখানে বসবাসরত জনগোষ্ঠীর নিজস্ব ভাষায় শিক্ষা, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের সংরক্ষণ ও বিকাশ নিশ্চিত করা অপরিহার্য,এমন সুস্পষ্ট ও তাৎপর্যপূর্ণ বক্তব্য উঠে এসেছে জাবারাং কল্যাণ সমিতির ৩০ বছর পূর্তি উপলক্ষে আয়োজিত আলোচনা সভা ও বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানে। ১৯৯৫ সালে খাগড়াছড়ি জেলার এক প্রত্যন্ত গ্রাম খাগড়াপুর থেকে যাত্রা শুরু করা জাবারাং কল্যাণ সমিতি (জাবারাং) আজ তিন দশক পেরিয়ে একটি স্বনামধন্য উন্নয়ন প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। এই গৌরবময় পথচলার ৩০ বছর পূর্তি উপলক্ষে রাজধানীর গুলশানে অবস্থিত ক্রাউন প্লাজা হোটেলে আজ এক ব্যতিক্রমী ও স্মরণীয় অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন এনজিও বিষয়ক ব্যুরোর সম্মানিত পরিচালক (যুগ্ম-সচিব) মো. আনোয়ার হোসেন। জাবারাংকে ৩০ বছর পূর্তির শুভেচ্ছা জানিয়ে তিনি বলেন,“পার্বত্য চট্টগ্রামকে উন্নয়নের মূলধারায় আনতে হলে সেখানকার জনগোষ্ঠীর মাতৃভাষাভিত্তিক শিক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। তাদের ঐতিহ্য ধারণ করতে হবে, লালন করতে হবে। জাবারাং এই ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে এবং ভবিষ্যতে আরও বড় ভূমিকা পালন করতে পারে। তিনি আরও জানান, প্রান্তিক ও ছোট উন্নয়ন সংস্থাগুলোর জন্য এনজিও ব্যুরো নীতিগতভাবে ইতিবাচক সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। এর অংশ হিসেবে এনজিও ব্যুরোর নিবন্ধন ছাড়াই ছোট স্থানীয় সংস্থাগুলো ডোনার-ফান্ডেড প্রকল্পে পার্টনার হিসেবে কাজ করতে পারবে। এছাড়া ৫০ লক্ষ টাকা পর্যন্ত প্রকল্প বাস্তবায়নে এনজিও ব্যুরোর অনুমোদনের প্রয়োজন হবে না—যা স্থানীয় উন্নয়ন উদ্যোগে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করবে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন বিভিন্ন সরকারি কর্মকর্তা, উন্নয়ন সহযোগী সংস্থার প্রতিনিধি, গবেষক, নাগরিক সমাজের সদস্য এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর প্রতিনিধিরা। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদের সদস্য প্রশান্ত কুমার ত্রিপুরা। বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ইউনেস্কোর হেড অব এডুকেশন নোরিহিদে ফুরুকাওয়া জাবারাংয়ের মাতৃভাষাভিত্তিক বহুভাষিক শিক্ষা (MLE) কার্যক্রমের প্রশংসা করেন এবং ভবিষ্যতে এ উদ্যোগ আরও বিস্তৃত ও সমৃদ্ধ হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন।
সংগ্রামের ইতিহাস, সাফল্যের গল্প: অনুষ্ঠানের উদ্বোধনী পর্বে পরিবেশিত হয় জাতীয় সংগীত ও পার্বত্য চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী সাংস্কৃতিক পরিবেশনা। স্বাগত বক্তব্যে জাবারাং কল্যাণ সমিতির নির্বাহী পরিচালক মথুরা বিকাশ ত্রিপুরা বলেন, “জাবারাংয়ের ৩০ বছরের পথচলা মূলত পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অধিকার, ভাষা, শিক্ষা ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের ইতিহাস।”
প্রামাণ্যচিত্র ও স্মারকগ্রন্থ উন্মোচন: অনুষ্ঠানে প্রদর্শিত হয় প্রামাণ্যচিত্র ‘জাবারাং: ৩০ বছরের পথচলা’, যেখানে সংস্থাটির মাতৃভাষাভিত্তিক বহুভাষিক শিক্ষা, টেকসই জীবিকা, যুব নেতৃত্ব বিকাশ, স্বাস্থ্য ও নারী ক্ষমতায়নে অবদানের চিত্র তুলে ধরা হয়।
উল্লেখ্য, মাতৃভাষাভিত্তিক শিক্ষায় অসামান্য অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে ২০২১ সালে জাবারাংয়ের নির্বাহী পরিচালক আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা পদকে ভূষিত হন—যা সংস্থাটির কাজের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির একটি মাইলফলক।
এছাড়া ৩০ বছর পূর্তি উপলক্ষে প্রকাশিত স্মারকগ্রন্থ ‘Roots to Impact’ আনুষ্ঠানিকভাবে উন্মোচন করা হয়। ‘Roots to Impact: গত ৩০ বছরে পার্বত্য চট্টগ্রামে উন্নয়ন এবং ভবিষ্যৎ কমিউনিটি ডেভেলপমেন্ট’ শীর্ষক প্যানেল আলোচনায় মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ড. হরি পূর্ণ ত্রিপুরা। উন্মুক্ত আলোচনায় নানা কণ্ঠ, এক অভিন্ন প্রত্যাশা জাবারাংয়ের প্রোগ্রাম ডিরেক্টর বিনোদন ত্রিপুরার সঞ্চালনায় মুক্ত আলোচনা পর্বে বক্তব্য রাখেন-বিএনসিইউ প্রতিনিধি মো. তাজউদ্দিন, গণসাক্ষরতা অভিযানের তপন কুমার দাশ, প্লান ইন্টারন্যাশনালের ফারজানা মেহরিন, সেভ দ্য চিলড্রেনের মেহেরুন নাহার স্বপ্না, ভিসিএফ নেটওয়ার্কের সভাপতি যুব লক্ষণ চাকমা, নারী হেডম্যান এখিন চৌধুরী, বাংলাদেশ নারী প্রগতি সংঘের সমন্বয়কারী সঞ্জয় মজুমদার, সিডব্লিউএফডির নির্বাহী পরিচালক ল্যাডলি ফায়েজ, বাংলাদেশ হেলথ ওয়াচ প্রতিনিধি মাসুদ আলম, উইভ সংস্থার নির্বাহী পরিচালক নাই ইউ প্রু মার্মা মেরী, দীঘিনালা ইউআরসি ইন্সট্রাক্টর মো. মাইনউদ্দিনসহ অনেকে।
ইতিহাস, ঐতিহ্য ও অর্জনের প্রদর্শনী: অনুষ্ঠানস্থলে একটি বিশেষ প্রদর্শনী কর্নারে জাবারাংয়ের ইতিহাসভিত্তিক আলোকচিত্র, প্রকাশনা, পার্বত্য চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী হস্তশিল্প ও কৃষিজ পণ্য প্রদর্শিত হয়। গণমাধ্যমকর্মীদের জন্য ছিল আলাদা প্রেস কর্নার, যেখানে জাবারাংয়ের ৩০ বছরের অর্জন তুলে ধরা হয় তথ্যপত্র ও অডিও-ভিজ্যুয়াল উপস্থাপনার মাধ্যমে।
উদযাপনের মধ্য দিয়ে প্রত্যয়ের ঘোষণা অনুষ্ঠানের শেষ পর্বে কেক কেটে জাবারাং কল্যাণ সমিতির ৩০ বছর পূর্তি উদযাপন করা হয়। এই আয়োজন যেন আবারও ঘোষণা করে দিল, নিজস্ব ভাষা, সংস্কৃতি ও স্থানীয় নেতৃত্বকে কেন্দ্র করেই পার্বত্য চট্টগ্রামের উন্নয়নের ভবিষ্যৎ নির্মিত হবে।
তারুণ্যের শক্তিকে কাজে লাগিয়ে উন্নত, মানবিক ও আধুনিক বাংলাদেশ গঠনের প্রত্যয়ে খাগড়াছড়িতে অনুষ্ঠিত হয়েছে ‘এসো দেশ বদলাই, পৃথিবী বদলাই’ শীর্ষক এক আলোচনা সভা। রবিবার (২১ ডিসেম্বর) দুপুরে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সম্মেলন কক্ষে এ সভা অনুষ্ঠিত হয়। জেলা তথ্য অফিসের আয়োজনে অনুষ্ঠিত এ আলোচনা সভায় সভাপতিত্ব করেন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) হাসান মারুফ। অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য রাখেন জেলা তথ্য অফিসার এস. এম. আল আমিন।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে জেলা প্রশাসক মোঃ আনোয়ার সাদাত বলেন, “আগামীর উন্নত ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গঠনে তরুণদের ভূমিকা অপরিসীম। সাম্প্রতিক জুলাই গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে তরুণদের নেতৃত্ব ও সাহসিকতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত আমরা দেখেছি। রাষ্ট্র ও সমাজ পরিবর্তনের মূল চালিকাশক্তি হলো তারুণ্য। তিনি আরও বলেন, দেশের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও দক্ষ ও অভিজ্ঞ মানবসম্পদ গড়ে তুলতে তরুণদের আত্মনিয়োগ করতে হবে। এতে একদিকে যেমন ব্যক্তিগত আর্থিক সচ্ছলতা আসবে, অন্যদিকে দেশও এগিয়ে যাবে উন্নয়নের পথে। আলোচনা সভায় বক্তারা একযোগে ‘এসো দেশ বদলাই, পৃথিবী বদলাই’ শ্লোগানকে হৃদয়ে ধারণ করে দায়িত্বশীল, সৃজনশীল ও সচেতন নাগরিক হিসেবে তরুণ সমাজকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান। তারা বলেন, তারুণ্যের উদ্ভাবনী চিন্তা, দেশপ্রেম ও নেতৃত্বের গুণাবলিই পারে একটি নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণ করতে।
অনুষ্ঠানে জেলার বিভিন্ন উপজেলার নির্বাহী অফিসারবৃন্দ, প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা, জেলা পর্যায়ের সরকারি কর্মকর্তা, তরুণ প্রজন্মের প্রতিনিধিবৃন্দ, সাংবাদিক এবং স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ উপস্থিত ছিলেন। উপস্থিত সকলেই এমন আয়োজনকে সময়োপযোগী ও অনুপ্রেরণাদায়ী উল্লেখ করে নিয়মিতভাবে তরুণদের সম্পৃক্ত করে এ ধরনের উদ্যোগ গ্রহণের ওপর গুরুত্বারোপ করেন।