ডিপিএস’র কোটি টাকা আত্মসাত: চট্টগ্রাম সিএমএম আদালতে মিজান গাজীর বিরুদ্ধে ৭টি মামলা
এইচ এম আলমগীর হোসেন, চট্টগ্রাম: চট্টগ্রাম মহানগরের ইপিজেড থানাধীন আকমল আলী রোডের পকেট গেইটস্থ মোজাম্মেল বিল্ডিং এর দ্বিতীয় তলায় ‘ছায়া স্বপ্ননীড় বহুমুখী সমবায় সমিতি লি:’ এর চেয়ারম্যান মো. মিজান গাজী প্রতারণা ও জালিয়াতির মাধ্যমে হাজার গ্রাহকের ডিপিএসের প্রায় কোটি টাকা আত্মসাত করে আত্মগোপনে রয়েছেন।
উক্ত সমবায় সমিতির সদস্যরা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় চরম হতাশায় দিন কাটাচ্ছেন। কোনো ভাবেই ডিপিএসের মাধ্যমে তাদের জমানো টাকা উদ্ধার করতে পারছেন না। প্রতিষ্ঠানের মালিক মো. মিজান গাজী উক্ত প্রতিষ্ঠানটি হঠাৎ বন্ধ করে তার নিজ বাড়ি ভোলা জেলার চরফ্যাসন উপজেলার দুলারহাট থানাধীন নীলকমল ঘোষেরহাট গ্রামে স্ত্রী-পুত্র নিয়ে বিলাসী জীবন যাপন করছেন। সমিতির সদস্য ও ভুক্তভোগী গ্রাহকদের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে উক্ত সমবায় সমিতির দশ জন সদস্যকে সঙ্গে নিয়ে চট্টগ্রাম থেকে এ প্রতিবেদকের সঙ্গে আরো পাঁচ জন প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার সংবাদকর্মী অনিয়ম ও দুর্নীতির অনুসন্ধানে যায় ভোলা জেলার চরফ্যাসনের নীলকমল ঘোষেরহাট গ্রামে ডিপিএসের টাকা আত্মসাতকারী প্রতারক মিজান গাজীর বাড়িতে। সরেজমিনে দেখা যায়, ডিপিএসের নামে হাজার গ্রাহকের কোটি টাকা আত্মসাতকারী মিজান গাজী টাইল্স দ্বারা দোতলা ভবন নির্মাণ করে তার স্বপরিবার নিয়ে আরাম আয়েশে বিলাসী জীবন যাপন করছেন। তার বাড়ির লোকজনের সাথে আলাপ করে জানা যায়, বিগত দুই বছরে তার ‘লাইফ স্টাইলে’ আমুল পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। ‘নুন আনতে পান্তা ফুরায়’ এমন পরিবারের সন্তান মিজান গাজী হঠাৎ আঙ্গুল ফুলে কলা গাছ হওয়ার রহস্য এতদিন স্থানীয় অনেকেরই অজানা ছিল।
স্থানীয় জনসাধারণের নিকট ‘দালাল বাড়ি’ হিসেবে পরিচিত মো. আবুল কাশেম দালালের সন্তান মো. মিজান গাজীর প্রাতিষ্ঠানিক কোনো শিক্ষাগত যোগ্যতা না থাকলেও দীর্ঘদিন যাবত চট্টগ্রাম শহরে বিভিন্ন তৈরি পোষাক কারখানায় চাকুরীর সুবাদে বাচন ভঙ্গিতে দক্ষতা অর্জন করায়, উক্ত প্রতিষ্ঠান চালু করে স্থানীয় সহজ সরল লোকজনকে নানা ভাবে লোভ লালসা দেখিয়ে তার প্রতিষ্ঠানে সদস্যভুক্ত করেছেন বলে ভুক্তভোগী গ্রাহকরা জানান। প্রথম দিকে উক্ত সমিতির চেয়ারম্যানের প্রতারণা ও জালিয়াতির বিষয়টি বুঝতে না পারলেও পরবর্তিতে চার বছর পরে প্রতিষ্ঠান চেয়ারম্যানের কর্মকান্ড সন্দেহ হয়, উক্ত প্রতিষ্ঠানের জেনারেল ম্যানেজার মো. আমিনুল ইসলাম রফিকের। প্রতিষ্ঠান চেয়ারম্যানের নানা রকম অনিয়ম-দুর্নীতি, সমিতির গঠনতন্ত্র বিরোধী কর্মকান্ডের কারণে স্বেচ্ছায় চাকুরী থেকে অব্যাহতির জন্য আবেদন করলেও প্রতারক চেয়ারম্যান মিজান গাজী কিছুতেই তার আবেদন গ্রহণ করতে রাজি হননি। অবশেষে উক্ত জেনারেল ম্যানেজার অনেক কষ্টে প্রতিষ্ঠানের আর্থিক হিসাব নিকাস সংক্রান্ত দায়িত্ব চেয়ারম্যানকে বুঝিয়ে দিয়ে অন্য প্রতিষ্ঠানে চাকুরী নেন।
উক্ত প্রতিষ্ঠানে চাকুরী না করার কারণে প্রতারক মিজান গাজী বিভিন্ন সময় তাকে প্রাণনাশের হুমকি ধামকি প্রদর্শন করায় এক পর্যায়ে মো. আমিনুল ইসলাম রফিক চট্টগ্রাম চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে মিজান গাজীর বিরুদ্ধে ফৌজদারী কার্যবিধি আইনের ৪৪ ধারায় সাধারণ ডায়েরী করতে বাধ্য হন। সূত্র: সাধারণ ডায়েরী নং-০৪/১৮ (ইপিজেড থানা)। ভুক্তভোগী মো. আমিনুল ইসলাম রফিক জানান, আমি উক্ত প্রতিষ্ঠানের সদস্য, ডিপিএসের মাধ্যমে তার নিকট আমার প্রায় ২ লক্ষ টাকা পাওনা। আমি মোবাইল ফোনে তার নিকট পাওনা টাকা চাইলে, তিনি আমাকে অশ্লীল ভাষায় গালিগালাজ করে, আমাকে মিথ্যা মামলায় জড়িয়ে জেল খাটানোর হুমকি দেয়। সরেজমিনে অনুসন্ধানে ভুক্তভোগী গ্রাহকদের সঙ্গে নিয়ে এ প্রতিবেদক চরফ্যাসন উপজেলার ৬নং নীলকমল ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. আলমগীর হোসেন হাওলাদার, দুলারহাট থানার ওসি. মো. মিজানুর রহমান পাটোয়ারী, চরফ্যাসন উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান মো. জয়নাল আবেদীন আকন, চরফ্যাসন পৌরসভার মেয়র বাদল কৃষ্ণ দেবনাথ, চরফ্যাসন উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মো. নুরুল ইসলাম ভিপিসহ আরো অনেকের সাথে প্রতারক মিজান গাজীর কর্মকান্ড সম্পর্কে আলাপ করলে, তারা সকলেই মিজান গাজীর সম্পর্কে নেতিবাচক মন্তব্য করে ভুক্তভোগীদের অতিদ্রুত আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের পরামর্শ দেন। নীলকমল গ্রামের একজন বাসিন্দা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, মিজান গাজীর বিরুদ্ধে স্থানীয়দের অনেক অভিযোগ রয়েছে, স্থানীয় একজন আওয়ামী লীগ নেতার ছত্রছায়ায় তিনি নানা অপকর্ম চালিয়ে যাচ্ছেন।
সমিতির নামে ডিপিএসের টাকা আত্মসাত প্রসঙ্গে অভিযুক্ত মো. মিজান গাজীর দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে, তার নিকট উক্ত সমবায় সমিতির সদস্যরা ডিপিএসের টাকা পাবে এমন অভিযোগের সত্যতা স্বীকার করেন। তিনি বলেন, আমি বেগতিক পরিস্থিতির কারণে ‘ছায়া স্বপ্ননীড় বহুমুখী সমবায় সমিতি লি:’ নামক প্রতিষ্ঠানের প্রধান কার্যালয় তালাবদ্ধ করেছি, তবে আমি আত্মগোপনে আছি এ কথা সঠিক নয়। আমার সাথে সমিতির সদস্য ও পাওনাদারদের মোবাইল ফোনে যোগাযোগ আছে, তাদের টাকা পরিশোধ করতে সময় লাগবে। অভিযুক্ত মো. মিজান গাজী ভুক্তভোগীদের অর্থ আত্মসাত সংক্রান্ত বিষয়ে গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশ না করার জন্য এ প্রতিবেদককে নানা ভাবে ম্যানেজ করার চেষ্টা করেন এবং রাজনৈতিক পরিচয়ে বিভিন্ন ব্যক্তিকে দিয়ে প্রতিবেদকের মোবাইলে ফোন করে তদবির করেন।
সিএমপির ইপিজেড থানা পুলিশ সূত্রে জানা যায়, প্রতারক মো. মিজান গাজী ইতিপূর্বে সমিতির টাকা আত্মসাত সংক্রান্ত মামলায় দীর্ঘদিন যাবত চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দি ছিলেন, বর্তমানে ইপিজেড থানায় তার বিরুদ্ধে একাধিক গ্রেপ্তারী পরোয়ানা রয়েছে। চট্টগ্রাম আদালত সূত্রে জানা যায়, প্রতারক মো. মিজান গাজী, তার স্ত্রী বিউটি বেগম, তার ভাই মো. ফিরোজ ও প্রতিষ্ঠানের ফিল্ড ম্যানেজার মো. শামিম এর বিরুদ্ধে সমিতির টাকা আত্মসাত সংক্রান্ত বিষয়ে ভুক্তভোগী মো. আবুল কাশেম এর সি.আর মামলা নং- ১২৯/২০১৮ (বন্দর থানা), ভুক্তভোগী নিপু কুমার দে’র সি.আর মামলা নং- ১৯৪/২০১৮ (ইপিজেড থানা), ভুক্তভোগী মালেকা বেগম এর সি.আর মামলা নং- ১৯৫/২০১৮ (ইপিজেড থানা), ভুক্তভোগী মো. মিলন হোসেন এর সি.আর মামলা নং- ১৯৬/২০১৮ (ইপিজেড থানা), ভুক্তভোগী রিনা বেগম, মিনারা বেগম, মেরিনা আক্তার, বিবি হাজেরা, তাসনুর বেগম, মরিয়ম বেগম, মো. কামাল হোসেন, মো. সিরাজ, জামুর আক্তার, তাজমহল বেগমগংদের সি.আর মামলা নং- ৫১/২০১৯ (ইপিজেড থানা), ভুক্তভোগী মো. শাহ আলম হাওলাদার এর ইপিজেড থানার মামলা নং- ২(১) ২০১৯ সহ আরো একটি মামলা প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। ‘ছায়া স্বপ্ননীড় বহুমুখী সমবায় সমিতি লি:’ এর সদস্যদের ডিপিএসের পাশ বই, অভিযুক্ত মো. মিজান গাজী কর্তৃক স্বাক্ষরিত ব্যাংক চেক, নন-জুডিসিয়াল স্ট্যাম্পের চুক্তিপত্র, জমা টাকার রশিদ, এফডিআরসহ অন্যান্য গ্রহণযোগ্য কাগজপত্র পর্যালোচনায় দেখা যায়, প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যানের নিকট প্রায় এক হাজার গ্রাহকের কোটি টাকা পাওনা রয়েছে। সমিতির নামে মোটা অংকের অর্থ আত্মসাত করে প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান মো. মিজান গাজী বিলাস বহুল বাড়ি নির্মাণ করে স্বাচ্ছন্দে জীবন যাপন প্রসংগে তার স্ত্রী বিউটি বেগমের বক্তব্য জানতে চাইলে তিনি জানান, আমার স্বামীর নিকট উক্ত সমিতির সদস্যরা তাদের জমানো টাকা পাবে সত্য, আমার স্বামীকে এই বাড়ি বিক্রি করে হলেও গ্রাহকদের পাওনা টাকা পরিশোধ করতে বলেছি।
অভিযুক্তের পিতা মো. আবুল কাশেম দালাল জানান, আমার ছেলে সমিতির টাকা আত্মসাত করে নিজের কাজে খরচ করেছে, সে আমাকে কোনো টাকা দেয় নাই। সরেজমিনে অনুসন্ধানে নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন জনপ্রতিনিধি জানান, মিজান গাজী চট্টগ্রাম ইপিজেডে তার প্রতিষ্ঠিত সমবায় সমিতির মোটা অংকের টাকা একটি বেসরকারি ব্যাংকে তার পরিবারের একজন সদস্যের নামে ফিক্স ডিপোজিট করেছে, উক্ত টাকার মাসিক লভ্যাংশ দিয়ে সে আরাম আয়েশে জীবন যাপন করছে। গ্রাহকদের পাওনা টাকা পরিশোধের কোনো ইচ্ছাই তার নাই। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, প্রতারক মো. মিজান গাজী কর্তৃক প্রতারিত হয়ে একাধিক ভুক্তভোগী গ্রাহক হার্টএটাক করে মৃত্যুবরণ করেছেন।