দীঘিনালায় ছাত্রী হত্যার ঘটনায় জড়িতদের খোঁজে পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থা
দীঘিনালা (খাগড়াছড়ি) প্রতিনিধি: খাগড়াছড়ির দীঘিনালায় ৫ম শ্রেণীর এক ছাত্রীকে হত্যা করা হয়েছে। নিহতের ক্ষতবিক্ষত লাশ শনিবার রাতে উদ্ধার করেছে পুলিশ। নিহত কৃত্তিকা ত্রিপুরা ওরফে পুনাতি (১১) উপজেলার নয়মাইল ত্রিপুরা পাড়ার মৃত নর্ন্দন ত্রিপুরার মেয়ে এবং নয়মাইল ত্রিপুরা পাড়া সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ৫ম শ্রেণীর ছাত্রী।
ঘটনার প্রতিবাদে সংশ্লিষ্ট বিদ্যালয়েল শিক্ষার্থী এবং স্থানীয়রা মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার মাধ্যমে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বরাবরে স্বারকলিপি দিয়েছে। পৃথকভাবে বিক্ষোভ মিছিল ও প্রতিবাদ সমাবেশ করেছে আঞ্চলিক রাজনৈতিক দল। স্থানীয় ও পুলিশ সূত্রে জানা যায়, শনিবার দুপুর থেকে সে নিখোঁজ হয়; পর রাত সাড়ে ১১টার দিকে নিজ বাড়ির সামনের সেগুন বাগান থেকে তার ক্ষতবিক্ষত লাশ উদ্ধার করা হয়। নিহতের স্বজন ও পুলিশ প্রাথমিকভাবে ধারনা কর‘েছ ওই ছাত্রীকে ধর্ষনের পর হত্যা করা হয়ে থাকতে পারে। নৃশংস এ হত্যাকান্ডের খবর পাওয়ার পর থেকেই স্থানীয়দের মাঝে চরম উত্তেজনা দেখা দেয়। সকাল থেকে অবরোধ করে রাখা হয় দীঘিনালা-খাগড়াছড়ি সড়ক। পরে অবশ্য প্রশাসন ও স্থানীয় সাংসদ এর আশ্বাসের প্রেক্ষিতে দুপুর ১২টায় অবরোধ তোলে নেওয়া হয়।
রবিবার সকালে ঘটনাস্থলে পৌছান জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার, দীঘিনালা জোন অধিনায়ক, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান, ওসিসহ প্রশাসনিক এবং আইন শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তাগন। অপরদিকে ঘটনার প্রতিবাদে এবং দোষীদের গ্রেফতারের দাবীতে নয়মাইল এলাকায় সকাল সাড়ে ১১টায় মানববন্ধন করেছে সংশ্লিষ্ট বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী এবং এলাকাবাসি। এছাড়া দীঘিনালা উপজেলা সদরে পৃথকভাবে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করে দোষীদের দ্রুত গ্রেফতারের দাবী জানিয়েছে পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ (পিসিপি)। িনিহতের স্বজন, প্রত্যক্ষদর্শি ও পুলিশ সূত্রে জানা যায়, লাশের চোখ, মুখে এবং ঘারসহ শরীরে আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। এছাড়া দুই হাত কনুইতে কাটা হয়েছে; গলা এবং পশ্চাৎদেশেও রয়েছে ধারালো অস্ত্রের আঘাতের ক্ষত।
নর্ন্দন ত্রিপুরার বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, পুনাতির মাসহ স্বজনরা বিলাপ করে কাঁদছিল। পুরো বাড়িতে শোকের ছায়া। কেউ তেমনভাবে কথাও বলতে পারছিলেননা। এর মধ্যেও জানতে চাইলে বিলাপ করতে করতেই পুনাতির মা অনুমতি ত্রিপুরা (৪০) জানান, বছর তিনেক আগে সড়ক দূর্ঘটনায় স্বামি মারা গেছেন। প্রতিদিনের মতো ঘটনার দিনও পুনাতির মা সারাদিন ব্যাস্ত ছিলেন দুর পাহাড়ে জুম চাষের কাজে। তিন সন্তানের মধ্যে বড় মেয়ের বিয়ে হয়েছে, মেঝ ছেলে গাড়িতে থাকেন। সংসারের ছোট মেয়ে পুনাতি ঘটনার দিনও বিদ্যালয়ে গিয়েছিল। কিন্তু বিকালে তার মা বাড়ি ফিরে পুনাতিকে না পেয়ে খোঁজ শুরু করেন। কোথাও তাঁর খোঁজ না পেয়ে বাড়ির সামনের জঙ্গলে গিয়ে মেয়ের ক্ষতবিক্ষত লাশ দেখতে পান। লাশের পরনে পেন্ট ছিলনা তবে গায়ে স্কুল ড্রেসের জামাটিই ছিল।
বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সূর্য্যশ্বর ত্রিপুরা জানান, পুনাতি দুপুরে টিফিন করার জন্য বাড়িতে গিয়ে আর ফিরেনি। তার বইগুলোও শ্রেণীকক্ষ্যে ছিল। বিদ্যালয় ছুটির পরও পুনাতিকে না পাওয়ায় তখন থেকেই খোঁজ শুরু করে স্থানীয়রা। পুনাতির সহপাঠি নতুন বালা ত্রিপুরা জানায়, সকাল থেকেই সে একসাথে ক্লাস করেছে। টিফিনের সময় সবাই টিফিন করে ফিরে আসলেও ফিরেনি পুনাতি; এরকম এর আগে কখনো হয়নি।
স্থানীয় ওয়ার্ড মেম্বার গনেশ ত্রিপুরা জানান, পাকা সড়ক সংলগ্ন পুনাতিদের ঘরটি অনেকটাই নিরিবিলি পরিবেশে। পুনাতি টিফিন করতে যখন বাড়ি আসে তখন সে ছাড়া আর কেউ ঘরে থাকেনা; হত্যাকারীরা হয়তো এ সুযোগটিই কাজে লাগিয়েছে।
রবিবার সকালে নয়মাইল এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, বিভিন্ন স্থানে গাছ কেটে সড়কের ওপর ফেলে অবরোধ করছিল স্থানীয়রা। বন্ধ থাকে সকল প্রকার যান চলাচল। সাথে মানববন্ধন করছিল বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী এবং স্থানীয় নারী পুরুষ। এদিকে ঘটনাস্থলে পৌছে নিহতের স্বজনদের সাথে কথা বলেন জেলা প্রশাসক মো. রাশেদুল ইসলাম, পুলিশ সুপার মো. আলি আহাম্মদ খান, দীঘিনালা জোন অধিনায়ক লেঃ কর্নেল ফেরদৌস জিয়া উদ্দিন মাহমুদ, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সদর সার্কেল) মো. আফতাব উদ্দিন, উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান নবকমল চাকমা, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. শেখ শহীদুল ইসলাম, খাগড়াছড়ি সদর থানার ওসি মো. সাহাদাত হোসেন টিটো, দীঘিনালা ওসি মো. আঃ সামাদ। পর টাষ্কফোর্স চেয়ারম্যান কুজেন্দ্রলাল ত্রিপুরা এমপিও এসে নিহতের স্বজনদের শান্তনা দেন। কুজেন্দ্রলাল ত্রিপুরা মানবন্ধনে উপস্থিত হয়ে সংক্ষিপ্ত বক্তব্যে বলেন, ‘ধর্ষণের পর এত নৃশংস হত্যাকান্ড এর আগে চোখে পড়েনি। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে এটি একটি পরিকল্পিত হত্যাকান্ড। শান্ত এলাকা নয়মাইলকে উত্তপ্ত করে রাজনৈতিক পরিবেশ ঘোলা করার জন্য এ ঘটনা হয়ে থাকতে পারে।’ এছাড়া এমপিসহ প্রশাসনিক কর্মকর্তাগন দোষীদের দ্রুত গ্রেফতার করে আইনের আওতায় আনার আশ্বাস দেওয়ার পর অবরোধ প্রত্যাহার করা হয়। অপরদিকে মানব বন্ধন শেষে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার মাধ্যমে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বরাবর একটি স্বারকলিপিও দেওয়া হয়েছে।
এছাড়া একই ঘটনার প্রতিবাদে দীঘিনালায় জনসংহতি সমিতি জেএসএস, এমএন লারমা) সমর্থীত পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ বিক্ষোভ মিছিল ও প্রতিবাদ সমাবেশ করেছে। মিছিলটি উপজেলা কমপ্লেক্স ঘুরে কলেজ মোড়ে গিয়ে সমাবেশে মিলিত হয়। কলেজ শাখার সাধারণ সম্পাদক রিংকো চাকমার সভাপতিত্বে বক্তব্য রাখেন উপজেলা শাখার সভাপতি সুনেন্দু চাকমা, সাধারণ সম্পাদক অমল বিকাশ চাকমা, সদস্য শিরোষ ত্রিপুরা, কলেজ শাখার সুকেশ চাকমা প্রমূখ। বক্তারা দোষীদের দ্রুত গ্রেফতার করে শাস্তি দাবী জানান।
দীঘিনালা থানার অফিসার ইনচার্জ মো. আঃ সামাদ ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করে জানান, মামলা দায়েরের বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন। তবে দোষীদের সনাক্ত করে আসামি গ্রেফতারের জন্য পুলিশসহ বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা এবং গোয়েন্দা পুলিশ জোর তৎপরতা চালাচ্ছে।