বাসন্তি চাকমা মহান সংসদে বক্তব্যে এ কী বললেন ? নিন্দার ঝড়
রিফাত শাহেদ রিদম
তিন পার্বত্য জেলা তথা রাংগামাটি, খাগড়াছড়ি আর বান্দরবান জেলার আসন মিলে পার্বত্য চট্টগ্রামে একটি সংরক্ষিত নারী আসন বরাদ্দ আছে। এবারের জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবার পর পার্বত্য জেলা খাগড়াছড়ি থেকে সংরক্ষিত নারী আসনে এমপি হয়েছেন বাসন্তী চাকমা। নতুন সাংসদ হিসেবে পার্বত্যবাসী জাতীয় সংসদে তার প্রথম ভাষণে নতুন রাজনীতির সোনালী দিনের হাতছানি দেখতে উদগ্রীব ছিলো। কিন্তু গত ২৬ ফেব্রুয়ারি জাতীয় সংসদে দেয়া তার ভাষণে পার্বত্য চট্টগ্রামে বিচ্ছিন্নতাবাদী, সংবিধান ও রাষ্ট্রবিরোধী অপশক্তির কণ্ঠস্বর প্রতিধ্বনিত হতে দেখে যারপরনাই বিস্মিত হয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি ও সহাবস্থান বিরোধী চক্রের প্রতি বাসন্তি চাকমার ভাষণে এমন সুস্পষ্ট সহানুভূতি ছিলো যে তাকে ঐ খুনী, ধর্ষক, নিপীড়ক গোষ্ঠীর গডমাদার বলে যে কারো ভুল হতে পারে।
একজন ব্যক্তি যখন জনপ্রতিনিধি হিসেবে কোন দায়িত্ব পান তখন কিন্তু তিনি নির্দিষ্ট কোন জাতি, বর্ণ, ধর্ম বা গোত্রের মুখপাত্র হিসেবে থাকেন না। তিনি হয়ে যান তার এলাকার সবার মুখপাত্র। পার্বত্য চট্টগ্রামে সৌহার্দ ও সম্প্রীতির রাজনীতি করতেই জননেত্রী শেখ হাসিনা শান্তিচুক্তি করেছিলেন। সেই হিসেবে বাসন্তী চাকমা একজন চাকমা সম্প্রদায়ের ব্যক্তি হলেও তিনি যখন মহান সংসদে পার্বত্য চট্টগ্রামের সংরক্ষিত নারী আসনের এমপি হিসেবে প্রতিনিধিত্ব করছে তখন কিন্তু তিনি পার্বত্য চট্টগ্রামের সকল সম্প্রদায়েরই প্রতিনিধি। কিন্তু গতকাল (২৬ ফেব্রুয়ারি) মহান জাতীয় সংসদে দাঁড়িয়ে তার প্রথম বক্তব্যে বাসন্তী চাকমা যে বক্তব্য প্রদান করেছেন তাতে একটা বিষয় সু-স্পষ্ট হয়েছে যে তিনি পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ে এখনো সাম্প্রদায়িক মনোভাব পোষণ করে আছেন। রাষ্ট্রবিরোধী শান্তিবাহিনীকে তিনি যেভাবে ভাই বলে সম্বোধন করেছেন তাতে তাকে শান্তিবাহিনীর প্রতি মমতাময়ী এক বোন বলেই মনে হয়েছে। এমনকি জেএসএসের ভাইস প্রেসিডেন্ট উষাতন তালুকদার এমপি হয়েও সংসদে যে ভাষণ রাখতে সাহস পায়নি বাসন্তি চাকমা সেই ভাষণই দিয়েছেন।
বাসন্তী চাকমা মহান সংসদে তার বক্তব্যে বলেছেন যে তার যখন ১৬/১৭ বছর বয়স তখন পার্বত্য চট্টগ্রামে অস্ত্রের ঝনঝনানি ছিলো। কিন্তু ঐ সময় যেই বিচ্ছিন্নতাবাদী সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা নিজেদেরকে “শান্তিবাহিনী” নাম দিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব বিরোধী কার্যক্রম পরিচালনা করছিলো তারাই যে এই অস্ত্রের ঝনঝনানির সৃষ্টি করেছিলো সে বিষয়টি তিনি সুকৌশলে এড়িয়ে যান। উপরন্তু তিনি শান্তিবাহিনীর সশস্ত্র সন্ত্রাসীদেরকে নিজের ভাই বলে আখ্যায়িত করেছেন। এ থেকে স্পষ্টতই প্রমাণিত হয় যে বাসন্তী চাকমা আজো সেই বর্বর শান্তিবাহিনীর মানসিকতা বয়ে বেড়াচ্ছেন।
বাসন্তী চাকমা তার বক্তব্যে স্বীকার করেছেন যে, পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তিবাহিনীর মধ্যে বিভেদের কারনে সন্তু গ্রুপ ও প্রীতি গ্রুপ নামে দুইটি গ্রুপের সৃষ্টি হয়েছিলো। ঐ দুই গ্রুপের অন্তর্কলহের কারনে বহু পাহাড়িকে প্রাণ দিতে হয়েছিলো। কিন্তু শান্তিবাহিনীর ঐ সন্ত্রাসীরা পার্বত্য চট্টগ্রামে যে হাজার হাজার বাংগালী আর নিরাপত্তাবাহিনীর সদস্যদের হত্যা করেছিলো সেই বিষয়টি তিনি সম্পূর্ণভাবে এড়িয়ে গিয়েছেন। কেন এই দ্বিমুখী আচরণ? এমন একজন দ্বিমুখী নেত্রীর কাছ থেকে পাহাড়ের উন্নয়ন আশা করা অসম্ভব।
বাসন্তী চাকমা তাঁর বক্তব্যে ১৯৮৬ সালের ১ মে খাগড়াছড়ি জেলার পানছড়ির একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করে বলেছেন যে ঐ দিন নাকি সেনাবাহিনী এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের বাংগালীরা মিলে “আল্লাহু আকবার” শ্লোগান দিয়ে পানছড়ির দুই তিন গ্রামের পাহাড়িদেরকে জবাই দিয়েছিলো। বাসন্তী চাকমার এই বক্তব্য অত্যন্ত সাম্প্রদায়িক উস্কানিমূলক এবং সম্পূর্ণ মিথ্যা একটি বক্তব্য। কারণ, উনি তাঁর বক্তব্যের প্রথমে ১৯৮৬ সাল বললেও ঠিক একটু পরেই আবার বলেন সেটা নাকি ১৯৯৬ সালের ঘটনা। হয়তো উনি কারো শেখানো বুলি আওড়াতে গিয়ে দিন তারিখ গুলিয়ে ফেলেছিলেন। যাই হোক, ১৯৮৬ এবং ১৯৯৬ আমি দুটি সালকেই সঠিক বলে ধরে নিলাম। এরপর ঐ সময়ে সংঘটিত পার্বত্য চট্টগ্রামের ঘটনাবলী অনুসন্ধান করা শুরু করলাম। সরেজমিনে ঘুরে আর পার্বত্য চট্টগ্রামের ইতিহাস ঘেটে যে তথ্য পেলাম তাতে আমি সম্পূর্ণভাবে নিশ্চিত হলাম যে বাসন্তী চাকমা মহান সংসদে দাঁড়িয়ে একটি মিথ্যা বিবৃতি দিয়েছেন।
প্রথমেই আসি ১৯৮৬ সালের ঘটনায়। ১৯৮৬ সালে পানছড়িতে একটি গণহত্যা হয়েছিলো ঠিকই তবে সেটা বাসন্তী চাকমার দেয়া তথ্য ১ মে তারিখে নয়। সেটি হয়েছিলো ২৯ এপ্রিল দিবাগত রাত আনুমানিক ৯টা থেকে রাত ১টা পর্যন্ত সময়ে। স্থান ছিলো খাগড়াছড়ি জেলার পানছড়ি উপজেলার লোগাং, চেঙ্গী, পানছড়ি, লতিবান, উল্টাছড়ি ৫টি ইউনিয়নের ২৪৫টি গ্রামে। ঐ দিন সেনাবাহিনী এবং বাংগালী মিলে কোন পাহাড়িকে “আল্লাহু আকবার” বলে জবাইও করেনি। বরং বাসন্তী চাকমার শান্তিবাহিনীর ভাইয়েরা ঐ এলাকার প্রত্যেকটি বাংগালী গ্রামে অগ্নিসংযোগসহ লুটতরাজ এবং নিরস্ত্র নিরীহ ৮৫৩ জনের অধিক বাংগালী নারী, শিশু, আবাল-বৃদ্ধ বনিতাকে হত্যা করে। বাংগালী নারীদেরকে পাকিস্তানী সেনাদের মত করে গণধর্ষণ ও পরে হত্যা করে। শান্তিবাহিনীর হামলায় ঐদিন আহত প্রায় ৫০০ জনের অধিক বাংগালী। ৬২৪০টি বাড়ি লুটতরাজ করে সম্পূর্ণভাবে পুড়িয়ে দেয় বাসন্তী চাকমার ভাই শান্তিবাহিনীর হায়েনারা। হাত-পা বেঁধে লাঠি দিয়ে পিটিয়ে, দা-দিয়ে নির্মমভাবে কুপিয়ে জবাই করে,আগুন দিয়ে পুড়িয়ে,বেয়নেট ও অন্যান্য দেশি অস্ত্র দিয়ে খুচিয়ে খুঁচিয়ে নানাভাবে কষ্ট দিয়ে হত্যা করেছিল এই অসহায় মানুষগুলোকে। প্রতিটি লাশকেই বিকৃত করে সেদিন চরম অমানবিকতার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিল বাসন্তী চাকমার ভাইয়েরা।
ঘটনাটি স্বচক্ষে দেখা এবং বেঁচে যাওয়া কিছু কিছু সাক্ষী আজো আছে। ১৯৮৬ সালের ২৯ এপ্রিল ঐ রাতে খাগড়াছড়ি জেলাতে বাসন্তী চাকমার শান্তিবাহিনীর ভাইয়েরা আরো কয়েকটি গণহত্যা চালিয়েছিলো যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলোঃ দিঘীনালা গণহত্যা ও মাটিরাংগা গণহত্যা। এছাড়াও, কুমিল্লাটিলা,শুকনাছড়ি, দেওয়ান বাজার, সিংহপাড়া, তাইন্দং গণহত্যা (১৯৮৬ সালের ১৮ মে) এবং দিঘীনালা গণহত্যা (১৯৮৬ সালের ২ জুলাই) ঐ বছরেই সংঘটিত হয়েছিলো যেখানে বাসন্তী চাকমার ভাই বর্বর শান্তিবাহিনী বাংগালীদেরকে নির্বিচারে হত্যা করেছিলো।
এবার আসি ১৯৯৬ সালের ঘটনায়। ১৯৯৬ সালের ৯ সেপ্টেম্বর সশস্ত্র সংগঠন শান্তিবাহিনীর বাসন্তী চাকমার গেরিলা ভাইয়েরা রাঙ্গামাটি জেলার লংগদু উপজেলার পাকুয়াখালীতে ৩৫ জন নিরীহ বাঙ্গালী কাঠুরিয়াকে নির্মমভাবে হত্যা করেছিলো। অবাক করার বিষয় হচ্ছে যে, শান্তিবাহিনী সেদিন এতগুলো মানুষকে হত্যা করতে একটি বুলেটও ব্যবহার করেনি। ৩৫ জনকেই জবাই করে তাদের মাথা শরীর থেকে আলাদা করে ফেলেছিলো, খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে বাসন্তী চাকমার ভাইয়েরা। অথচ বাসন্তী চাকমা মহান সংসদে দাঁড়িয়ে কি নির্বিকারভাবে ইতিহাস বিকৃতি করে বক্তব্য দিয়ে গেলেন!!! এমন সাম্প্রদায়িক মানসিকতার এক নেত্রীকে ধিক্কার জানানোর ভাষা জানা নেই।
এটা সকলেই জানে, পার্বত্য চট্টগ্রাম ইস্যুকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে তুলে ধরার কৌশল হিসেবে শান্তিবাহিনীরা পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতীয়দের শরণার্থি হিসেবে ভারতে পাঠানোর কৌশল গ্রহণ করে। কিন্তু শান্তিপ্রিয় পাহাড়ীরা নিজ ভিটা মাটি ছেড়ে যেতে না চাইলে তাদের উপর হত্যা, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ, লুটতরাজ, অপহরণের মতো নিপীড়নের স্টিম রোলার চালায়। এতে কিছুটা সফল হলেও চুড়ান্ত সফলতা না আসায় শান্তিবাহিনীর সদস্যরা কৌশলে পাহাড়ী গ্রামের সন্নিহিত বাঙালী গ্রামগুলোতে অগ্নিসংযোগ, হত্যা ও ধর্ষণের ঘটনা ঘটাতে শুরু করে যাতে বাঙালীরা উত্তেজিত হয়ে প্রতিক্রিয়া হিসেবে পাহাড়ী গ্রামগুলোতে আক্রমণ করে। শান্তিবাহিনীর এ কৌশল কাজে দেয়। এভাবে অনেক নিরীহ পাহাড়ী ভারতে পালিয়ে গেলে শান্তিবাহিনী শরণারর্থি ইস্যু ইস্যুর মোড়কে তাদের দাবী বিশ্ব দরবারে তুলে ধরতে সক্ষম হয়।
বাসন্তী চাকমা নিজেও নাকি প্রাণ বাঁচাতে বর্ডার পাড়ি দিয়ে ভারতে গিয়েছিলেন। যেই শান্তিবাহিনীকে উনি নিজের ভাই বলে সম্বোধন করেছেন তাদের ভয়ে কেন তিনি ভারতে গিয়েছিলেন সেটা বুঝতে পারলাম না।
বাসন্তী চাকমা পার্বত্য চট্টগ্রামের বাংগালীদেরকে ‘বহিরাগত‘, এবং ‘সেটেলার‘ বলে আখ্যায়িত করেছেন। এ ধরণের উগ্র সাম্প্রদায়িক টাইপের কথা বলে উনি কি পার্বত্য চট্টগ্রামের মোট জনগোষ্ঠীর প্রায় অর্ধেক (৪৯%) বাংগালী জনগোষ্ঠীকে হেয় প্রতিপন্ন করলেন না? বাসন্তী চাকমা যাদেরকে ‘বহিরাগত’ এবং ‘সেটেলার’ বলছেন এই বাংগালীরাই এই দেশের মূল জনগোষ্ঠী। বরঞ্চ, বাসন্তী চাকমার পূর্ব-পুরুষরাদেরেই এই দেশে ‘বহিরাগত’ এবং ‘সেটেলার‘ বললে অত্যুক্তি হয় না মোটেই।
ইতিহাস পর্যালোচনা করে দেখা যায় যে, চাকমারা মঙ্গোলীয় জাতির একটি শাখা। বর্তমান মিয়ানমারের আরাকানে বসবাসকারী ডাইনেক্টিং জাতিগোষ্ঠীকে চাকমাদের একটি শাখা হিসেবে গণ্য করা হয়।
‘‘বাংলাপিডিয়া মতে, আনুমানিক ১৫৫০ খ্রিষ্টব্দের দিকে পর্তুগিজ মানচিত্র প্রণেতা লাভানহা অঙ্কিত বাংলার সর্বাপেক্ষা পুরাতন ও এ পর্যন্ত অস্তিত্বশীল মানচিত্রে পার্বত্য চট্টগ্রামের এই চাকমাদের সম্পর্কে উল্লেখ পাওয়া যায়। কর্ণফুলীর নদীর তীর বরাবর চাকমাদের বসতি ছিল। চাকমাদের আরো আগের ইতিহাস সম্পর্কে দুটি তাত্ত্বিক অভিমত প্রচলিত। উভয় অভিমতে মনে করা হয়, চাকমারা বাইরে থেকে এসে তাদের বর্তমান আবাসভূমিতে বসতি স্থাপন করে। সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য তাত্ত্বিক অভিমত অনুযায়ী, চাকমারা মূলত ছিল মধ্য মায়ানমারের আরাকান এলাকার অধিবাসী।
তবে বাংলাদেশের আদিবাসী: এথনোগ্রাফিয় গবেষণা পুস্তকের মতে, কিংবদন্তী অনুযায়ী অতীতে চাকমারা চম্পকনগর নামে একটি রাজ্যে বাস করত। চম্পক নগর ত্রিপুরা রাজ্যেরই কাছাকাছি কোন জায়গায় অবস্থিত ছিল। এ ব্যাপারে নানা সাক্ষ্যও পাওয়া যায়। অশোক কুমার দেওয়ানের অনুমানে উত্তর ত্রিপুরার কোন স্থানে বসবাসকারী চাকমারা সেখানে আনুমানিক দুশ থেকে আড়াইশ বছর কাল অতিবাহিত করার পর পঞ্চদশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে উত্তর ত্রিপুরা থেকে দক্ষিণ এবং দক্ষিণ পূর্বদিকে সরে আসতে থাকে এবং পঞ্চদশ শতকের শেষ দিকেই পার্বত্য চট্টগ্রামের কর্ণফুলী এবং তার উপনদীসমূহের উপত্যকা ভূমিতে ছড়িয়ে পড়ে। এই হিসাব অনুযায়ী পার্বত্য চট্টগ্রামে চাকমাদের আগমন ৫০০ বছরের বেশি নয়।
চাকমা রাজবংশের ইতিহাস অনুযায়ী বিজয়গিরিকে ১ম রাজা ধরলে ৩২/৩৩ তম রাজা হচ্ছেন অরুণযুগ (ইয়াংজ )। তার শাসনকাল আনুমানিক ১৩১৬ খ্রিষ্টাব্দ হতে ১৩৩৩ খ্রিষ্টাব্দ। চাকমা ঐতিহাসিকদের মতে অরুণ যুগের পতনের পরপরই অর্থাৎ ১৩৩৩ খ্রিষ্টাব্দে চাকমারা বার্মা থেকে চট্টগ্রামে বা পার্বত্য চট্টগ্রামে আগমন করেন‘‘ ।(সূত্র: বাংলাদেশে আদিবাসী বিতর্ক, মেহেদী হাসান পলাশ, পার্বত্য নিউজ,১৫ মে ২০১৪।)
রাজা ভুবনমোহন রায় বিরচিত এবং বিপ্রদাশ বড়ুয়া সম্পাদিত ‘চাকমা রাজবংশের ইতিহাস’ নামক বইয়ে উল্লেখ করা আছে যে, ‘চাকমা ও বড়ুয়ারা দীর্ঘকাল চট্টগ্রাম ও আরাকানে বাস করলেও তাঁরা এখানকার আদি বাসিন্দা নন জানতে পারি। চাকমারা চম্পকনগর থেকে এসেছেন- সেই হারানো চম্পকনগরের সংখ্যা এক নয়, একাধিক- তাও জানতে পারি’।
বৃটিশ কর্ণেল প্রী (Colonel Phyree) চট্টগ্রামের বড়ুয়া ও চাকমাদের ব্রহ্ম ইতিহাসের ৪৭ নম্বর পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেছেন যে, ‘বড়ুয়া ও চাকমাদের আকৃতিগত বৈশিষ্ট্যতার জন্য তাঁহারা দক্ষিণ বিহার অর্থাৎ মগধ হইতে আসিয়া থাকিবেন’।
আসামের ব্রহ্মপুত্রের তীরবর্তীতে চাকমা রাজ্যের রাজধানী ছিল চম্পক নগর। অনেকে বিশ্বাস করে চম্পকনগর ভারতের উত্তর-পশ্চিম প্রদেশ থেকে অনেক দূরে অবস্থিত এবং চাকমারা চন্দ্র বংশের ক্ষত্রীয়দের উত্তরসূরী কিন্তু তাদের চেহারার বা মুখমন্ডলের বৈশিষ্ট্য আর্যদের চেয়ে মঙ্গোলীয়দের সঙ্গে অধিক সাদৃশ্যপূর্ণ। সিংহভাগ চাকমাদের বিশ্বাস, তারা উচ্চ বর্ণের হিন্দুদের পরবর্তী বংশধর।
তিন পার্বত্য জেলার সংরক্ষিত নারী আসনের এমপি হয়েও বাসন্তী চাকমা এই অঞ্চলের নারীদের উন্নয়ন সম্পর্কিত কোন কথা না বলে শান্তিবাহিনীর গুণগান আর সেনাবাহিনী ও বাংগালীদের সম্পর্কে বিষোদগার করে গিয়েছেন (যা ছিলো সম্পূর্ণ মিথ্যা)। অথচ, মিতালী চাকমা, রিমি চাকমা, জোসনা চাকমা, শুবলপুরি চাকমা, দীপা ত্রিপুরা, আয়না চাকমা, বালাতি ত্রিপুরা, বিশাখা চাকমার মত হাজার হাজার নির্যাতিতা ও খুন হওয়া নারীদেরকে নিয়ে একটি কথাও বলেননি।
বাসন্তি চাকমার ভাগ্য ভাল তাকে ভোটে নির্বাচিত হয়ে সংসদ সদস্য হতে হয়নি। যদি কোনোদিন এমন দিন আসে তাহলে বাসন্তি চাকমা তার কোনো ভাইদের তার পাশে দেখতে পাবেন না একথা নিশ্চিত বলা যায়। বিশ্বাস না হলে তাকে তিন পার্বত্য জেলার নির্বাচিত এমপিদের কাছে ভোটের মাঠের তরতাজা অভিজ্ঞতার কথা জানতে অনুরোধ করবো। পরপর তিনবার বিপুল ভোটে নির্বাচিত আওয়ামী লীগ কেন পার্বত্য চট্টগ্রামে উপজেলা, ইউপি নির্বাচনে প্রার্থি পায় না, কেন বাঘাইছড়ি, বিলাইছড়ি, জুড়াছড়ি, বরকল প্রভৃতি উপজেলা থেকে দলে দলে পাহাড়ী নেতারা আওয়ামী লীগ থেকে পদত্যাগ করতে হয়, কেন আওয়ামী লীগের অঙ্গ সংগঠনের কোনো কোনো ইউনিটে নেতা হওয়ার জন্য কোনো পাহাড়ী নেতা পাওয়া যায় না, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো প্রতিষ্ঠানে ছাত্রলীগ করার কারণে পাহাড়ী ছাত্রদের পেটানো হয়, কেন পাহাড়ের মাটি প্রায়ই আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের রক্তে রঞ্জিত হচ্ছে- এসব তথ্য তার জানা প্রয়োজন। বাসন্তি চাকমাকে অনুরোধ করবো, সদ্য সমাপ্ত জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও চলমান উপজেলা নির্বাচনে কারা আওয়ামী লীগের প্রধান নির্বাচনী শক্তি ও হাতিয়ার? তারা কি বাসস্তি চাকমার ভাইয়েরা, নাকি তার ভাষায় ‘বহিরাগত‘ বাঙালিরা? একথা ধ্রুব সত্য যে, তিন পার্বত্য জেলায় বাঙালীরাই এখন আওয়ামী লীগের প্রধান রাজনৈতিক শক্তি।
১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রী বংগবন্ধু কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার সুযোগ্য নেতৃত্বে শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হবার পর সমগ্র পার্বত্য চট্টগ্রামে যখন শান্তি, সম্প্রীতি ও উন্নয়নের জোয়ার বইতে শুরু করেছে, ঠিক তখনই বাসন্তী চাকমার এই ধরনের উস্কানিমূলক ও সাম্প্রদায়িক বক্তব্য পার্বত্য চট্টগ্রামে আবারও অশান্তির পথ সৃষ্টির সুযোগ করে দিচ্ছে নয় কি? প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পার্বত্য চট্টগ্রামে মেডিকেল কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, পর্যটন ও অবকাঠামো খাতে বিপুল বিনিয়োগ ও উন্নয়ন কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছেন, বাসন্তি চাকমার ভাইয়েরা সেই উন্নয়নকে বাঁধাগ্রস্ত করছে। অথচ তাদেরকেই যখন বোন পরিচয়ে আঁচলে আড়াল করতে চান বাসন্তি চাকমা তখন তার উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক।
পার্বত্য চট্টগ্রাম ও ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর প্রতি অত্যন্ত আন্তরিক জননেত্রী শেখ হাসিনা ঔদার্য দেখিয়ে তিন পার্বত্য জেলার সকল এমপিই ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মধ্য থেকে মনোনীত করেছেন। সেই ঔদার্য ও সুযোগকে কাজে লাগিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে সাম্প্রদায়িকতার বিষবৃক্ষ রোপন করতে চাইছেন কি বাসন্তি চাকমা? আমরা মনে করি, তিনি তার দলের, বা নিজের কথা বলছেন না, কারো শিখিয়ে দেয়া বা মতলবি কথা বলছেন। আমরা মনে করি, নতুন এমপি হিসেবে তিনি স্বাভাবিক আবেগের উদ্গিরিত লাভা তিনি ধারণ করতে ব্যর্থ হয়েছেন। তবে পার্বত্য চট্টগ্রামের জনমানুষের নেত্রী হতে গেলে, আওয়ামী লীগের মতো অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দলের আদর্শিক চর্চা করতে হলে তাকেও অসাম্প্রদায়িক রাজনীতি চর্চা ও সন্ত্রাসী, বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনের সাথে গোপন ও প্রকাশ্য সমর্থন, সহানুভূতি ত্যাগ করতে হবে। আগামী দিনে তার কাছ থেকে তেমন রাজনীতিই প্রত্যাশা করে পার্বত্যবাসী।
* লেখক: খাগড়াছড়ি থেকে