• July 27, 2024

ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশনের যে ৬ কারণে আতংকে বাঙ্গালিরা

বিশেষ প্রতিবেদক: ৬ কারণে ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আতংকে আছে পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত বাঙ্গালীরা। কমিশনের কার্যক্রম শুরুকে কেন্দ্র করে আবারো উত্তপ্ত পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন জেলা রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান ।

পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক পরিষদের নেতারা যে কারণগুলোর কথা বলছেন তার প্রথমত, ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশনে বাঙ্গালী প্রতিনিধিত্ব নেই, দ্বিতীয়ত কমিশনে পাহাড়িদের সংখ্যাগরিষ্ট প্রতিনিধিত্ব, তৃতীয়ত আবেদনকারীদের দরখাস্ত শুনানীর যেকোন পর্যায়ে সংশোধন করার সুযোগ রাখা, চতুর্থত ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশনের সিদ্ধান্তের বিরূদ্ধে উচ্চতর আদালতে আইনী লড়াইয়ের সুযোগ না রাখা, পঞ্চমত প্রচলিত আইন, আদালত ও ভুমি সংক্রান্ত দলিলাদীকে পাশ কাটিয়ে রীতি-নীতি ও পদ্ধতি অনুযায়ী ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তির সুযোগ, ষষ্ঠত ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশনে কর্মকর্তা ও কর্মচারী নিয়োগে অসমতা।

নেতারা বলছেন এসব কারণে বাঙালীরা ভুমিহীন হয়ে পড়ার আশংকা করছেন। যার ফলে সংগঠনটি গত ২১ ডিসেম্বর, ২২ ও ২৩ ডিসেম্বর পার্বত্য তিন জেলায় ভূমি কমিশন আইন সংশোধন করার দাবীতে ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন অফিস ঘেরাও, প্রধানমন্ত্রীকে স্মারক লিপি প্রদান, বিক্ষোভ সমাবেশ, মানববন্ধন ও সংবাদ সম্মেলন করেছে। দ্রুত কমিশন আইন সংশোধন ও আইনানুগ পদ্ধতিতে ভূমি কমিশনের কার্যক্রম চালু ও ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি করার উদ্যোগ না নিলে আন্দোলন চলবে বলে হুমকিও দেন সংগঠনটির নেতাকর্মীরা।

পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক পরিষদ সদস্য ইঞ্জিনিয়ার মোঃ আবদুল মজিদ বলেন ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশনে প্রথমত বাঙ্গালীদের প্রতিনিধিত্ব নেই, দ্বিতীয়ত কমিশনে পাহাড়ি সম্প্রদায়ের সংখ্যাগরিষ্ঠতা বাঙ্গালীদের জন্য প্রধান উদ্বেগের কারণ। তিনি পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইন-২০০১ (সংশোধিত-২০১৬) এর ৭ (৫) ধারার কথা উল্লেখ করে বলেন উক্ত ধারায় বলা আছে চেয়ারম্যান উপস্থিত অন্যান্য সদস্যদের সহিত আলোচনার ভিত্তিতে ধারা ৬(১) এ বর্ণিত বিষয়াদিসহ উহার এখ্তিয়ারভুক্ত অন্যান্য বিষয়ে সর্বসম্মতির ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিবে, তবে সর্বসম্মত সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া সম্ভব না হইলে চেয়ারম্যানসহ উপস্থিত সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যদের গৃহিত সিদ্ধান্তই কমিশনের সিদ্ধান্ত বলিয়া গণ্য হইবে বিধান রাখা হয়েছে ।

তিনি একই আইনের ৩(২) ধারায় কমিশন গঠন সম্পর্কে যে বিধান রাখা হয়েছে, সেখানে জেলা ভিত্তিক ৫ সদস্যের মধ্যে থাকছেন (ক)বাংলাদেশ সুপ্রীম কোটের একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি, যিনি উহার চেয়ারম্যানও হইবেন; (খ) আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান বা তাঁহার প্রতিনিধি, (গ) সংশ্লিষ্ট পার্বত্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান বা তার প্রতিনিধি, (ঘ) সংশ্লিষ্ট সার্কেল চীফ বা তৎকর্তৃক মনোনীত একজন প্রতিনিধি এবং (ঙ) চট্টগ্রাম বিভাগের বিভাগীয় কমিশনার বা তার মনোনীত একজন অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনারের কথা বলা হয়েছে। অর্থ্যাৎ ৫জনের মধ্যে ৩জন পাহাড়ি সম্প্রদায়ের, একজন বিচারক এবং একজন সরকারের প্রতিনিধি। তাহলে কমিশনে পাহাড়িরাই সংখ্যা গরিষ্ঠ। তাহলে যে বাঙালীদের সাথে পাহাড়িদের ভূমি বিরোধ, সেই বাঙালী জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব নেই এবং যেহেতু কমিশনের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্য পাহাড়ি সম্প্রদায়ের হওয়ায় ৭(৫) ধারার সুবিধা পাহাড়িরা পাবে। বাঙ্গালীরা ভূমিহীন হবার আশংকা থাকছেই।

পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক পরিষদের যুগ্ম আহ্বায়ক এবং সাবেক বাঘাইছড়ি পৌরসভার মেয়র আলমগীর কবির ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইনকে সংবিধান বিরোধী উল্লেখ করে বলেন তৃতীয়ত এই আইনের ৯৷ ২[ (১)] এই আইনের অধীনে ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য সংশ্লিষ্ট আবেদনকারী তাহার দস্তক্ষত বা টিপসহিযুক্ত দরখাস্ত সাদা কাগজে বাংলা ভাষায় লিখিয়া কমিশনের নিকট দাখিল করিবেন। এবং ৩[ (২) কমিশন কর্তৃক উক্ত আবেদন নিষ্পত্তির পূর্বে যে কোন সময়ে ন্যায় বিচারের স্বার্থে, কমিশনের অনুমতি সাপেক্ষে, আবেদনকারী তাঁহার আবেদন একবার সংশোধন করিতে পারিবেন মর্মে সুযোগ দিলেন। অর্থ্যাৎ আইনের ১০ (১) ধারার অধীনে দায়েরকৃত প্রতিটি আবেদনে প্রতিপক্ষ হিসাবে সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসক, অবৈধ বন্দোবস্ত গ্রহীতা তথা বাঙ্গালী জনগোষ্ঠী এবং ক্ষেত্রমত আবেদনকারীর জানামতে দাবীকৃত ভূমির বর্তমান দখলকার এর নাম ও ঠিকানা উল্লেখ করে অভিযোগ দায়েরের পর যখন তারা (প্রতিপক্ষ বাঙ্গালীরা) জবাব দিবেন, সেই জবাব বিশ্লেষন করে আবেদনকারী পাহাড়িরা পুনরায় তার দরখাস্ত সংশোধন করার সুযোগ পাবে-যা নামান্তরে বাঙ্গালী উচ্ছেদের নীল নকশা। তাছাড়া চতুর্থত আইনের ১৬ ধারার ৬(১)-এ বর্ণিত কোন বিষয়ে দাখিলকৃত আবেদনের উপর কমিশন প্রদত্ত সিদ্ধান্ত দেওয়ানী আদালতের ডিক্রী বলিয়া গণ্য হইবে, তবে উক্ত সিদ্ধান্তের বিরূদ্ধে কোন আদালত বা অন্য কোন কর্তৃপক্ষের নিকট আপীল বা রিভিশন দায়ের বা উহার বৈধতা বা যথার্থতা সম্পর্কে কোন প্রশ্ন উত্থাপন করা যাইবে না মর্মে রাখা বিধানও অসাংবিধানিক। এগুলো পরিবর্তন করা না হলে পার্বত্য চট্টগ্রাম হতে বাঙ্গালী উচ্ছেদের জন্য ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইনই যথেষ্ঠ।

পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক পরিষদের আহবায়ক ইঞ্জিনিয়ার আলকাছ আল মামুন বলেন, ভুমি কমিশন আইনটি সংবিধান বিরোধী। এই আইনের বাস্তবায়নের জন্য সংবিধানকে মানা হবেনা-এটা মেনে নেওয়া যায়না। তিনি ৫ম কারণ হিসেবে ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইনের ৬ ধারায় কমিশনের কার্যাবলী অংশে ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তিতে প্রথাগত রীতি, নীতি ও পদ্ধতিকে প্রাধান্য দেয়া হয়েছে এবং আইনের ১৭ (১), যেখানে উল্লেখ আছে অন্য কোন আইনে যাহা কিছুই থাকুক না কেন কমিশনের সিদ্ধান্ত দেওয়ানী আদালতের ডিক্রী, বা ক্ষেত্রমত, আদেশের ন্যায় কমিশন উহার কর্মকর্তা ও কর্মচারীর মাধ্যমে বা প্রয়োজনবোধে সরকারী কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করিতে বা করাইতে পারিবে মর্মে উল্লেখ আছে। প্রচলিত ভূমি আইনে স্বত্ত্ব প্রমানে দলিলাদীকে অস্বীকার করে বায়বীয় কথা, গল্প, কাহিনী তথা রীতি-নীতি ও পদ্ধতিকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। বাস্তব দখল ও দখল সংক্রান্ত দলিলাদী এবং কার্যকর করার জন্য প্রচলিত আইন, আদালত ও প্রশাসনকে অস্বীকার করে ভুমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশনের উপর আস্থা রাখছেন সন্তু লারমা ও তার দোসরেরা। এতে করে পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত বাঙ্গালীরা ভূমিহীন হওয়ার আশঙ্কায় রয়েছে। তিনি আরো বলেন ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তিতে প্রচলিত ভুমি আইন, প্রচলিত আদালত ব্যবস্থা বা প্রচলিত শাসন ব্যবস্থাকে প্রাধান্য না দিলেও বিতর্কিত ভুমি কমিশন তাদের প্রদত্ত সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে প্রচলিত প্রশাসন ও আইনি প্রতিষ্ঠানগুলোকে ব্যবহার করতে চান। এতে করে পার্বত্য চট্টগ্রামের অনেক বাঙ্গালী বাসিন্দাই ভূমিহীন হবে এবং দেশের সার্বভৌমত্বও হুমকিতে পড়বে। তারা কোনভাবেই ভূমি কমিশনের এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানাতে পারেন না। কারণ ভুমি কমিশন আইনটিই বিতর্কিত, পার্বত্য চট্রগ্রাম থেকে বাঙ্গালী উচ্ছেদের নীল নকশা। তিনি নীল নকশা বাস্তবায়নে তড়িগড়ি করায় কমিশন চেয়ারম্যানকে পক্ষপাতদুষ্ঠু হিসেবে অভিহিত করেন এবং কমিশন চেয়ারম্যান যতদিন পার্বত্য এলাকায় আসবেন, ততদিনই কর্মসূচি দেওয়ার হুমকি দেন।

পার্বত্য বাঙ্গালী দলপতি পরিষদের সভাপতি মোঃ আবদুল আজিজ আকন্দ ৬ষ্ঠ কারন হিসেবে ভুমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইনের ১৩ ধারায় সচিব, কর্মকর্তা ও কর্মচারী নিয়োগের ক্ষেত্রে উপজাতীয়দের প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে, সেই হিসেবে নিয়োগও দেওয়া হয়েছে উল্লেখ করে বলেন পাহাড়ে পাহাড়ি-বাঙ্গালি প্রায় সমান সমান। নিয়োগের ক্ষেত্রে শুধু উপজাতীয়দের প্রাধান্য অসাংবিধানিক। গণবিজ্ঞপ্তি প্রকাশ, অভিযোগ গ্রহণ, নোটিশ ইস্যু, আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম চালু, সিদ্ধান্তসহ সকল কার্যক্রমে পাহাড়িরা কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা পাহাড়িদেরই সাহাস্য করবে। ফলে ভুমি বিরোধ নিষ্পত্তি বাঙ্গালীদের জন্য সুখকর হবেনা। তিনি আরো বলেন অতিতে ভুমি কমিশন আইনটি সংশোধনের জন্য যেমন হরতাল-অবরোধসহ বিভিন্নভাবে আন্দোলন করেছেন, তেমনি নিয়ম-তান্ত্রিক পদ্ধতিতে ভবিষ্যতেও আন্দোলন করবেন। যদি সফল না হন তাহলে প্রয়োজনে উচ্চ আদালতে যাবেন।

পার্বত্য চট্রগ্রামের ভুমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন সুত্রে জানা যায়, পার্বত্য চট্রগ্রামে ভুমি বিরোধ নিষ্পত্তি করার লক্ষ্যে কমিশন চেয়ারম্যানের অনুমতিক্রমে গত ০৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৬ইং তারিখে একটি গণ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেছেন। ভুমি বিরোধ নিষ্পত্তি করার লক্ষ্যে ক্ষতিগ্রস্থদের ৪৫দিনের মধ্যে আবেদন চেয়ে গণবিজ্ঞপ্তি জারী করেছিল পার্বত্য চট্রগ্রাম ভুমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন। পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশনে ৩ পার্বত্য জেলা থেকে অভিযোগ জমা পড়েছে ২২ হাজার ৯০টি।

পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশনের চেয়ারম্যান অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি আনোয়ারুল হক বলেন পার্বত্য চট্টগ্রামে বিরাজমান ভুমি বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য সরকার ভুমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন করেছে। সরকারের আন্তরিকতা আছে উল্লেখ করে তিনি আরো বলেন ভূমিসহ অন্যান্য সমস্যা সমাধানে কোন জাতিগোষ্ঠী ক্ষতিগ্রস্থ হবেনা। তবে কোন ধারা অসাংবিধানিক হলে তা আলোচনা করা যেতে পারে

পাহাড়ের আলো

https://pahareralo.com

সর্বাধিক জনপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল। সর্বশেষ সংবাদ সবার আগে জানতে চোখ রাখুন পাহাড়ের আলোতে।

Related post