মহামুনি বৌদ্ধ মেলার জমজমাট আয়োজন
আবদুল মান্নান, মানিকছড়ি: বাংলা নববর্ষ মানে আনন্দের জোয়ার। দেশব্যাপি নানা আয়োজনে দিবস পালন করা হলেও পাহাড়জুড়ে এ আনন্দের মাত্রায় পাহাড়ী-বাঙ্গালী একাকার। বিশেষ করে মংরাজ আবাসস্থল মহামুনি চত্বরে প্রতি বছরের ন্যায় এবারও ১৪ এপ্রিল শনিবার জমবে মেলার ১৩৫তম আসর। আর এ আয়োজন উপভোগ করতে তিন পার্বত্য জেলা এবং চট্টগ্রাম থেকে হাজারো নর-নারী, শিশু-কিশোর,তরুণ-তরুণীরা জমায়েত হবে পাহাড়ী-বাঙ্গালীর মিলনস্থল। ইতোমধ্যে মেলার সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছেন আয়োজন কমিটি। ১৩ এপ্রিল বিকালে পুরাতন বছরকে বিদায় ও পহেলা বৈসাক’কে স্বাগত জানিয়ে বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা বের করেছে মারমা উন্নয়ন সংসদ। এতে হাজার হাজহার পাহাড়ী-বাঙ্গালীর শিশু –কিশোর,তরুণ-তরুণী,বৃদ্ধ-বনিতারা দলে দলে নিজস্ব ব্যানারে সংস্কৃতি তুলে ধরেন।
মহামুনি মেলার ইতিবৃত্ত:
মহামুনি বুদ্ধ মূর্তি সহিত মেলার তাৎপর্য-মানিকছড়িতে প্রত্যেক বছর মহামুনি টিলায় মেলা বসে। আর বর্তমানে এ মেলাকে অনেকে সাংগ্রাই মেলা, বৈসাবি মেলা, বৈসাবিন মেলা ও বৈশাখি মেলা বলে থাকে। আসলে মেলাটা হবে ‘মহামুনি বুদ্ধ মেলা’। এই মহামুনি মেলা হওয়া প্রসঙ্গে আমরা কয়েকটি বিষয়ে স্পষ্ট অবতারণা হতে পারি তা হল-মহামুনি টিলায় বুদ্ধ মূর্তি স্থাপনকে নিয়ে। ১৭৮৪ সালে মিয়ানমার (বার্মা ) আরাকান সম্রাজ্যে থেকে মূর্তি নিয়ে এসে মংসার্কেলের মংরাজা কংজয় বাহাদুর চট্টগ্রাম পাহাড়তলীতে ‘মহামুনি’নামক বুদ্ধ মূর্তি স্থাপন করেন। আর ১৮৮৩ সালে আরেক মং রাজা বাহাদুর নিপ্রুসাইন মানিকছড়িতে‘মহামুনি’বুদ্ধ মূর্তিটি মিয়ানমার (বার্মা) মান্দালয় প্রদেশ থেকে অষ্ট ধাতু দিয়ে নির্মিত মুর্তিটি নিয়ে এসে মহামুনি টিলায় স্থাপন করা হয়। তখন থেকে এ মহামুনি টিলায় প্রত্যেক বছরে মারমা পঞ্জিকা অনুসারে মেলা বসে। মূর্তি স্থাপন প্রথম দিকে কিন্তু মেলা জাকঁজমক ছিলনা। আশি দশকের পর মেলা জাকঁজমক হতে থাকে। মূলত এ মহামুনি মেলা হওয়া উদ্দেশ্য হল ‘মহামুনি’ বুদ্ধ মুর্তি স্থাপনের বর্ষপূর্তি হিসেবে। এবার মেলার ১৩৫তম বর্ষ। আর এ মেলার দিন পঞ্জিকা থাকলেও অনেক সময় ইংরেজি ১৪ এপ্রিলে সাথে মিলে যায় বলে অনেকে মনে করে বৈশাখী মেলা। কিন্তু আসলে তা নয় , দেখা যায় , ১৯৯৫ সালে মহামুনি মেলা উৎসব পালিত হয় ১৪ এপ্রিলে এবং ১৯৯৬ সালে অনুষ্ঠিত হয় ১৩ এপ্রিলে। আর গত বছর ২০১৫ সালে মেলার তারিখ ছিল ১৪ এপ্রিল এবং গত ২০১৬ সালে মেলা হয়েছিল ১৩ এপ্রিল। এবার ২০১৭ ও ২০১৮ সালে হচ্ছে ১৪ এপ্রিল। আবার আগামী ২০১৯ সালে হবে ১৩ এপ্রিল। আবার কোন কোন বছর গ্রহ-নক্ষত্র অবস্থানগত কারণে এ উৎসব তারতম্য হয় যেহেতু মারমাব্দ সম্পূর্ণ চন্দ্রালোকের উপর নিভরশীল তাই সৌরমন্ডলের উপর ভিত্তি করে হয়ে থাকে । কথিত আছে , এ মহামুনি বুদ্ধ মূর্তিটি মহাকারুনিক গৌতম বুদ্ধ জীবিত থাকাকালীন সময় এবং বুদ্ধ মিয়ানমার (বার্মা) দেশের আরাকান প্রদেশে অবস্থানকালে আরাকান প্রদেশে মহারাজা চাইন্দা সুরিয়া(চন্দ্র-সুর্য) বুদ্ধের অনুমতি নিয়ে তৈরি করা হয় এ বুদ্ধের প্রতিমূর্তি । আর ধরে নেওয়া যায় এটিই পৃথিবীর বা জগতের প্রথম বুদ্ধ মূর্তি।
সাংগ্রাই সম্পর্কে মনীষীদের অভিমত ও মারমাব্দ প্রবর্তন- কিংবদন্তী ‘সাংগ্রাই’সর্ম্পকে বিশিষ্ট মনীষীদের তাঁদের মতামত ব্যাখ্যা করেছেন এভাবে, তারাঁ বলেন,‘ সাংগ্রাই’ দিন ‘তাবতিংস স্বর্গ’থেকে ‘ব্রাইমামাংগ্রী’ বা ব্রক্ষ্মমহারাজা আলোকিক শক্তি নিয়ে মনুষ্যলোকে অবতরণ করেণ। তখন মনুষ্য লোকেরা তাঁর উদ্দেশ্যে পূজা আচ্চর্ণা করেন। মারমা সমাজের সাংগ্রাই নির্ধারণের মূল ভিত্তি হলো মারমা বর্ষপঞ্জি। এই বর্ষপঞ্জি আজ থেকে ১৩৭৭ বছর মগাব্দ বা মারমাব্দ শতাব্দী গণনার ইতিহাস শুরু হয়েছিল। এ মারমা সাল গণনাকে ‘গজ্জাসাকরাই’ বলে। এই বর্ষপঞ্জি চন্দ্রলোক বা চাদঁ দেখার উপর অনুসরণ করে প্রর্বতন করা হয়েছে। এ বর্ষপঞ্জিকাটি রাষ্ট্রীয়ভাবে বার্মা (মিয়ানমার) রাজ দরবার থেকে প্রবর্তিত হয়েছিল। মিয়ানমার অধীশ্বর রাজা থেঙ্গা রাজা বা পৌক পা সৌ ‘ মারামাব্দ সনের প্রর্বতক।
সাংগ্রাই উৎসব পরিক্রমা: মারমাদের সাংগ্রাই উৎসব থাকে মূলত ৭ দিন ব্যাপী। ১ম দিন:- মারমারা এই দিনে নিজ নিজ বসতঘর, কাপড়-চোপর,বাড়ির আঙ্গিনা সমূহ পরিস্কার পরিছ্ন্ন করে থাকে। এছাড়া নির্ধারিত দিনের তারা মেহমানদের অগ্রীম দাওয়াত দেন। ২য় দিন:-মারমাদের সাংগ্রাই পর্বে ২য় দিনকে ‘পাইংছোয়াই’(ফুল সংগ্রহ দিন) বলা হয়। ঐ দিন নানা প্রকার ফুল সংগ্রহ করে বুদ্ধকে পূজা করে থাকে। এবং সাংগ্রাই উৎসকে আসার আগমন জানানো হয়। এই আগমনের জন্য প্রত্যেক এলাকায় স্ব-উদ্দ্যোগে সাংগ্রাইকে বরণ করার নিমিত্তে বিভিন্ন সামাজিক ও রাজনৈতিক সংগঠন আনন্দ র্যালী ও আলোচনাসভা করে থাকে। ৩য় দিন:-সাংগ্রাই ৩য় দিনে ‘সাংগ্রাই’ চুড়ান্ত শুভাগমন ঘটার দিন। এ দিনে মারমারা বুদ্ধকে ছোয়াইং দান,ফুল পূজা, প্রদীপ পূজাসহ শীল পালন ও পিতা-মাতা,গুরু জনদের পূজা অর্ঘ্য প্রদান করেন। ঐ দিন ‘জিংবুদ্ধিবা ক্যইং’(পৃথিবী) কে স্বাক্ষী রেখে ‘তরোবোয়ে’(সংঘদানের জন্য যা প্রয়োজন হয়) ও ‘পিদিসা’ (কল্পতরু) সাজিয়ে দান করা হয়। জন্ম-জন্মান্তর ,স্বর্গ সুখ ও সর্বোপরি নির্বাণ সুখ লাভের কামনা করে থাকে। ৪র্থ দিন:-সাংগ্রাই ৪র্থ দিনকে বলা হয় ‘আক্যাই’এই দিনে মারমারা বিভিন্ন ধরণের শাকসজ্জ্বি সংগ্রহ করে এবং ২য় দফায় আমন্ত্রিত অতিথিদের আবার দাওয়াত করে স্মরণ করিয়ে দেয়। ৫ম দিন:- সাংগ্রাই ৫ম দিনকে বলা হয় ‘আতাদা’ এ দিনে সকালে বুদ্ধ পূজা,ভিক্ষু সংঘকে পিন্ডদান, দুপুরে অতিথিদের আপ্যায়ন,পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে বেড়ানো, বয়স্কদের নিকট আর্শীবাদ কামনা, প্রত্যেকে বাড়িতে বিভিন্ প্রকারে পিঠা তৈরি, এ সময় মারমাদের ৩২ প্রকারের ঐতিহ্যবাহী প্রাচীন সজ্জ্বি খাবার ‘ফাসং’ রান্না করে অতিথিদের পরিবেশন করা হয়। এছাড়া রয়েছে ঐতিহ্যবাহী জনপ্রিয় পানি খেলা,‘ধহ্’খেলা, কাংছি,আকাশচুম্বী বাশঁ উঠা ,হাডুডু ও ফুটবল খেলা ইত্যাদি। ৬ষ্ঠ দিন:- সাংগ্রাই ৬ষ্ঠ দিন বা শেষ দিনকে বলা হয় ‘আপ্যাইং’ অর্থ্যাৎ সাংগ্রাই প্রত্যাবর্তন বা নির্গমনের দিন । এ দিনে সাংগ্রাই দৃশ্য-অদৃশ্য প্রতীয়মান হয়। মারমারা এ দিনে ধর্মীয় ভাবগাম্বীর্যে মধ্য দিয়ে দিনগুলোকে সর্বশেষ বিদায় ও নতুন বছরকে স্বাগতম জানাই । ৭ম দিন:- এই দিনে ও যাহারা কাজে কর্মে ব্যন্ত জীবন কাটিয়েছিল তারা বা সময় পেরে উঠতে পারেনি তারা সেই দিনে অতিথিদের আমন্ত্রন জানিয়ে বিভিন্ন সু-স্বাদু খাবার দিয়ে পরিবেশন করা হতো। বাংলাদেশের সকল জাতির ও সকল সম্প্রদায়ের বসবাসের একটি দেশ। এবং এদেশের মানুষ মূলত উৎসব প্রিয়। তাই এ দেশের সকল জনগোষ্ঠী তাদেঁর নিজ নিজ ধর্ম ও ঐতিহ্য-সংস্কৃতি টিকে রাখুক এবং নিজেদের ঐতিহ্যকে নিজেরাই লালন-পালন করুক এ নতুন বছরের দিনগুলোতে এ প্রত্যাশা সকলের।
এদিকে পুরাতন বছরকে বিদায় ও নববর্ষকে স্বাগত জানিয়ে ১৩ এপ্রিল শুক্রবার বিকালে মানিকছড়িতে বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা বের করেছে উপজেলা মারমা উন্নয়ন সংসদ। শুক্রবার বিকাল ২টার পর উপজেলার গচ্ছাবিলস্থ চৌধুরী পাড়া, তিনটহরী নামার পাড়া,বড়বিল,রাজপাড়া,মহামুনি পাড়া থেকে দলে দলে মারমা শিশু-কিশোর,তরুণ-তরুণী, বৃদ্ধ-বনিতারা“সাংগ্রাই (বৈসাবি)কে বিদায় ও বরণ করতে শোভাযাত্রায় সমবেত হয়। উপজেলার গচ্ছাবিলস্থ চৌধুরী পাড়া, মযূরখীল ধর্মঘর,তিনটহরী চৌধুরী পাড়া,বড়বিল, রাজপাড়া, মহামুনি পাড়া ,বাটনাতলী থেকে দলে দলে মারমা শিশু-কিশোর,তরুণ-তরুণী, বৃদ্ধ-বনিতারা“সাংগ্রাই (বৈসাবি)কে বিদায় ও বরণ করতে শোভাযাত্রায় সমবেত হয়। ১ কিলোমিটার দীর্ঘ শোভাযাত্রায় হাজারো পাহাড়ী-বাঙ্গালীর উপস্থিতিতে আনন্দের মাত্রা বাড়িয়ে দিয়েছে পাহাড়ে।
চারিদিক থেকে আসা শোভাযাত্রাটি বেলা সাড়ে ৪টায় আমতলায় এসে মূল¯্রােতধারায় মিলিত হয়। পরে সেটি উপজেলা পরিষদ ঘুরে মহামুনি বৌদ্ধ মেলাস্থল হেডম্যান কার্যালয় মাঠে গিয়ে শেষ হয়। উক্ত শোভাযাত্রায় প্রধান অতিথি ছিলেন, উপজেলা চেয়ারম্যান ¤্রাগ্য মারমা, বিশেষ অতিথি ছিলেন, ইউএনও মো.আহ্সান উদ্দীন মুরাদ, অফিসার ইনচার্জ মুহাম্মদ রশীদ, উপজেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি মো. জয়নাল আবেদীন, ইউপি চেয়ারম্যান মো.শফিকুর রহমান ফারুক, যুবলীগ নেতা মো. সামাউন ফরাজী সামু, মো. জাহাঙ্গীর আলম,মারমা সংসদ নেতা মংশেপ্রু মারমা, কার্বারী এসোসিয়েশনের সভাপতি উদ্রাচাই কার্বারীসহ হাজারো শিশু-কিশোর,তরুণ-তরুণীরা নানা সাজে সজ্জিত হয়ে শোভাযাত্রায় অংশ নেয়।