মাহে রমজানের সওগাত-১৭
মুহাম্মদ আলতাফ হোসেন
আজ ১৭ রমযান, ঐতিহাসিক বদর দিবস। হিজরী দ্বিতীয় বর্ষের রমযান মাসের এই দিনে বদর প্রান্তরে ইসলামের প্রথম সম্মুখ যুদ্ধে মহান রাববুল আলামীন সরাসরি সাহায্য দানের মাধ্যমে মুসলমানদের বিজয় দান করেন। তাই এ দিবসকে ইয়াওমুল ফুরকান বা সত্য মিথ্যার পার্থক্যের দিন বলা হয়। সত্যপথের অনুসারী অল্প সংখ্যক রোযাদার মুসলমান বিশাল অস্ত্রেশস্ত্রে সজ্জিত মিথ্যার অনুসারী কাফের মুশরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে জয়লাভ করে সত্য মিথ্যার চির পার্থক্য সূচিত হয়ে যায়।
মুহাম্মদ (সাঃ) ও তাঁর অনুসারীরা মক্কা থেকে মদীনায় হিযরত করে মদীনায় শান্তিতে অবস্থান করবে, চতুর্দিকে ইসলামের দাওয়াত পৌঁছাবে, মুহাম্মদের নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা হবে এটা কাফের কুরাইশ বাহিনী কখনোই চায়নি। কোন মুসলমান পেলেই কোন কারণ ছাড়াই শুধু ঈমান আনার অপরাধে তার ওপর অত্যাচারের খড়গ চালাতো। নির্মম নির্যাতনের স্টিমরোলার চালিয়ে হত্যা করতে বিবেকে বিন্দুমাত্র নাড়া দিতো না। এদিকে কুরাইশ নেতা আবু সুফিয়ান ও তার বাহিনী সিরিয়া থেকে বিভিন্ন রসদ সামগ্রী নিয়ে মক্কায় ফিরতে ছিল। মহানবী (সাঃ) তাঁর সাহাবাদেরকে কুরাইশদের গতিরোধ করার জন্য নির্দেশ দেন। মুসলমানরা বের হয়েছে এ সংবাদ মক্কায় পৌঁছার সাথে সাথে তারা রণশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে মদীনায় আক্রমণ ও মুসলমানদের নিশ্চিহ্ন করার লক্ষ্যে বদর প্রান্তরে এসে জড়ো হয়। এদিকে আবু সুফিয়ানও তার দল রাস্তা পরিবর্তন করে নিরাপদে পৌঁছে যায়। মহানবী (সাঃ)-এর সাথে জনবল ছিল মাত্র ৩শ’ ১৩ জন। এদের ৭০ জন মুহাজির ও বাকীরা আনসার। অপরদিকে কাফের, কুরাইশ বাহিনীর সংখ্যা ছিল ১ হাজার। তন্মধ্যে ১০০ জন অশ্বারোহী, ৭০০ জন উস্ট্রারোহী ও বাকীরা পদব্রজী ছিল। মূলত: মুসলমানদের যুদ্ধ উদ্দেশ্য ছিল না বরং কাফেরদের ব্যবসায়ী কাফেলাকে ধরা উদ্দেশ্য ছিল। রাসুল (সাঃ) যখন কাফেরদের বের হবার কথা জানতে পারলেন তখন সাহাবাদের সংঘবদ্ধ করে বললেন, নিশ্চয়ই আল্লাহ আমার সাথে ওয়াদা করেছেন দু’টি দলের একটি হয়তো ব্যবসায়ী কাফেলা অথবা অন্যটি সৈন্যবাহিনী। সাহাবাগণ রসুলুল্লাহ (সাঃ)-এর বিচলিত অবস্থা দেখে বললেন যে, হে রাসূল (সাঃ) আপনি আমাদেরকে ধৈর্যশীল, যুদ্ধের ময়দানে দৃঢ় অবস্থানকারী, আনুগত্যশীল, সাহসী, অকুতভয় ও নির্দেশ বাস্তবায়নে আপোসহীন ও দ্রুতগামী পাবেন। নবী করিম (সাঃ) মুহাজির ও আনসারদের কথা শুনে খুশী হয়ে বললেন- তোমরা সুসংবাদ গ্রহণ কর। আমি আল্লাহ তা’আলার শপথ করে বলছি আমার এমন মনে হচ্ছে যে, আমি যেন মুশরিক জাতির হত্যাযজ্ঞ লক্ষ্য করছি। অতঃপর নবী করীম (সাঃ) সাহাবীদের নিয়ে বদর কূপের নিকট পৌঁছেন। কুরাইশরা অপর প্রান্তে অবস্থান করলো। রাতে আল্লাহ তা’আলা এমন বৃষ্টিবর্ষণ করেন যা কাফিরদের জন্য বিরাট বিপদ হয়ে দাঁড়ায়। ফলে তারা সম্মুখে অগ্রসর হতে পারেনি। অপরদিকে মুসলমানদের জন্য সুবিধা হয়। সম্মুখ যুদ্ধ শুরু হলে রাসুলুল্লাহ (সাঃ) আল্লাহর কাছে দু’হাত তুলে ফরিয়াদ করতে থাকেন। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) দোয়ায় বলতে থাকেন, হে আল্লাহ! এ কঠিন মুহূর্তে আপনি আমাকে সাহায্য করুন, যার প্রতিশ্রুতি আপনি আমাকে দিয়েছেন, হে আল্লাহ! আমি আপনার প্রদত্ত ওয়াদা ও প্রতিশ্রুতির শপথ করে বলছি, যদি আপনি বিজয়ী না করেন, তাহলে এ পৃথিবীতে আপনার ইবাদত করার কেউ থাকবে না। মহান রাববুল আলামীন রসুলুল্লাহ (সাঃ) ও সাহাবাদের ডাকে সাড়া দিলেন। যা আল-কুরআনের সূরা আল আনফালের ১২-১৪ আয়াতে আল্লাহ তাআলা বর্ণনা করেছেন, ‘‘আর স্মরণ করুন সেই সময়ের কথা, যখন আপনার রব ফেরেশতাদের কাছে এ মর্মে প্রত্যাদেশ পাঠালেন যে, নিশ্চয়ই আমি তোমাদের সাথে আছি। তোমরা পরস্পরে ঈমানদারদের মনোবল ও সাহস বৃদ্ধি করো। আর আমি অচিরেই কাফেরদের অন্তকরণে ভয়-ভীতি সৃষ্টি করবো। তোমরা কাফিরদের ঘাড়ে আঘাত কর এবং জোড়ায় জোড়ায় আঘাত কর।’’ অন্যত্র বলা হয়েছে- ‘‘আর আল্লাহ এমন সৈন্যবাহিনী দিয়ে তোমাদের সাহায্য করেছেন যা তোমরা দেখ নাই।’’ রাসূল (সাঃ)-এর উৎসাহব্যাঞ্জক কথা শুনে উমাইর ইবনে হুমাম (রাঃ) হাতের খেজুর ফেলে দিয়ে বলতে লাগলেন, আমি কি শহীদ হলে জান্নাতে যাবো। রসুল (সাঃ) উত্তরে বললেন, হ্যাঁ। একথা শুনে উমাইর (রাঃ) খেজুর রেখে দিয়ে বললেন, আমি যদি জীবিত থাকি এবং খেজুরগুলো খেতে থাকি, তাহলে আমার জীবন দীর্ঘ হয়ে যাবে। এ বলেই তিনি খেজুর নিক্ষেপ করে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে শাহাদাত বরণ করলেন। যুদ্ধে কাফের কুরাইশ বাহিনী শোচনীয় পরাজয় বরণ করে এবং তারা যুদ্ধের ময়দান ছেড়ে পলায়ন করে। ৭০ জন কাফের নিহত ও ৭০ জন বন্দি হয়। অপরদিকে মুসলমানদের মধ্য হতে ১৪ জন শহীদ হন।
বদর যুদ্ধের মাধ্যমে সত্য মিথ্যার পার্থক্য সুনিশ্চিত হয়েছে। এটি ছিল একটি অসম যুদ্ধ। যুদ্ধে অল্পসংখ্যক সৈন্যবাহিনী বেশি সংখ্যক সৈন্যবাহিনীর ওপর বিজয় অর্জন করেছিল। সূরা আলে ইমরানের ১৩নং আয়াতে আল্লাহ উভয় দলের পরিচয় তুলে ধরে বলেছেন, ‘‘এদের মধ্যকার একটি দল আল্লাহর রাস্তায় সংগ্রাম করে আর অপর দল ছিল কাফির।’’