৯৫৪ টি সোলার প্যানেল স্থাপনে দুর্নীতির অভিযোগ, বিতরণ বন্ধ
স্টাফ রিপোর্টার: পাহাড়ের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর জীবনমান ও ভাগ্যের উন্নয়নে নানা প্রকল্প গ্রহণ করছে বর্তমান সরকার। খাগড়াছড়ির বিভিন্ন উপজেলায় বড় বড় মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড। কিন্তু তৃণমূলের কিছু অসাধু জনপ্রতিনিধির আর্থিক দুর্নীতির কারণে সরকারের উন্নয়নমুলক কর্মকাণ্ড ব্যাহত ও বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃক বরাদ্দকৃত ৯৫৪ টি সোলার প্যানেল স্থাপনের নামে সীমাহীন দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে পার্বত্য জনপদ খাগড়াছড়ির মানিকছড়ি উপজেলার ২নং বাটনাতলী ইউনিয়নে। পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রত্যন্ত দূর্গম এলাকায় সোলার প্যানেল স্থাপনের মাধ্যমে বিদ্যুৎ সরবরাহ প্রকল্প (দ্বিতীয় পর্যায়)- নামীয় প্রকল্পে ২নং বাটনাতলী ইউনিয়ন পরিষদের ১নং ওর্য়াডে ৬৪ টি, ২নং ওয়ার্ডে ১৩৯ টি, ৩নং ওয়ার্ডে ১৬৯ টি, ৭নং ওয়ার্ডে ২৮৩ টি, ৮নং ওর্য়াডে ২৪৫ টি, ৯নং ওয়ার্ডে ৫৪ টি সোলার প্যানেল উন্নয়ন বোর্ড থেকে বরাদ্দ আসে। অনুসন্ধানে জানা যায়, ২নং বাটনাতলী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. আব্দুর রহিম, ১নং ওয়ার্ড মেম্বার আবুল কালাম আজাদ, ২নং ওর্য়াড মেম্বার আদৌ মার্মা, ৩নং ওয়ার্ড মেম্বার মংপাইপ্রু মার্মা, ৪নং ওয়ার্ড মেম্বার মো. শফিকুর রহমান, ৭নং ওয়ার্ড মেম্বার মো. আব্দুল মমিন, ৮নং ওয়ার্ড মেম্বার মানিক ত্রিপুরা, ৯নং ওয়ার্ড মেম্বার মহরম আলী পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের অফিস খরচের নাম ভাঙ্গিয়ে প্রত্যেক উপকারভোগীর নিকট থেকে ৪ থেকে ৫ হাজার টাকা উত্তোলন করে তালিকা তৈরি করে। পরবর্তীতে সব মিলিয়ে ৯৫৪ জনের পূর্ণাঙ্গ তালিকা পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের সংশ্লিষ্ট প্রকল্প পরিচালকের দপ্তরে দাখিল করেন তারা। স্থানীয় এলাকাবাসী ও পরিষদের অন্যান্য জনপ্রতিনিধিদের সাথে আলাপ করে জানা যায়, ২নং বাটনাতলী ইউনিয়নের ওই ৬ টি ওয়ার্ড থেকে পরিষদের চেয়ারম্যান মো. আব্দুর রহিমের নেতৃত্বে সংশ্লিষ্ট ওয়ার্ড মেম্বারগণ সোলার প্যানেল দেওয়ার নামে প্রায় ৪০ লক্ষাধিক টাকা জনগণের নিকট থেকে উত্তোলন করেছেন। বিগত ২১ মার্চ-২০২৩ ইং তারিখে পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান নিখিল কুমার চাকমা ও ভাইস-চেয়ারম্যান নুরুল আলম চৌধুরী সরেজমিনে বাটনাতলী ইউনিয়নে সোলার প্যানেল বিতরণ কার্যক্রম আনুষ্ঠানিক ভাবে উদ্বোধন করতে আসলে, উক্ত জনপ্রতিনিধিদের সীমাহীন অনিয়ম ও দুর্নীতির বিষয়টি প্রকাশ পায়।
উপস্থিত তালিকাভুক্ত সুবিধাভোগীদের সকলেই টাকার বিনিময়ে তালিকায় নাম অন্তর্ভুক্তির বিষয়টি তাদের নিকট স্বীকার করেন। উন্নয়ন বোর্ড অফিস সূত্রে জানা যায়, এসব প্রতিটি সোলার প্যানেলের মূল্য ৪৫ হাজার টাকা। এদিকে ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বার-চেয়ারম্যানদের আর্থিক দুর্নীতির বিষয়টি সরেজমিনে অবগত হয়ে, তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ সহ সোলার প্যানেল বিতরণ কার্যক্রম স্থগিত ঘোষণা করেন পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান ও ভাইস-চেয়ারম্যান। এ সময় উন্নয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান ও ভাইস-চেয়ারম্যান সকলের টাকা ফেরৎ দিয়ে পুর্বের তালিকা বাতিল করত: নতুন ভাবে তালিকা তৈরি করার জন্য অভিযুক্ত জনপ্রতিনিধিদের নির্দেশ দেন। কিন্তুু তারা উন্নয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান ও ভাইস- চেয়ারম্যানের নির্দেশনা কর্ণপাত না করে বরং উক্ত প্রস্তাবিত উপকারভোগীদের পরিবার সমূহ হতে স্বামীর পরিবর্তে স্ত্রী, স্ত্রীর পরিবর্তে স্বামী, পিতার পরিবর্তে পুত্র, ভাইয়ের পরিবর্তে বোন, বোনের পরিবর্তে ভাই- এভাবে কারসাজির মাধ্যমে ওয়ার্ড ভিত্তিক নতুন তালিকা তৈরির কাজে নিয়োজিত রয়েছেন। সোলার প্যানেলে নাম তালিকাভুক্তির বিনিময়ে ৩ হাজার টাকা মানিক ত্রিপুরা মেম্বারকে দেওয়ার কথা স্বীকার করেন ছদুরখীলের বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. আমির আলী। উপজাতীয় বাসিন্দা তানিমং মারমা, অংশেপ্রু মারমা ও পাইতু মারমা জানান, তাদের নিকট থেকেও সোলার প্যানেল দেওয়ার কথা বলে ৩ হাজার টাকা করে নিয়েছেন মানিক ত্রিপুরা মেম্বার। একই সাথে অফিস খরচের নামে প্রত্যেকের নিকট থেকে পূণরায় ১ হাজার, আবার কোথাও থেকে ১ হাজার ৫০০ টাকা করে উত্তোলন করছেন এসব জনপ্রতিনিধিরা।
টাকার বিনিময়ে তালিকায় নাম অন্তর্ভুক্তির কথা স্বীকার করেন বাটনাতলী ইউনিয়ন ছাত্রলীগ নেতা মো. আকতার হোসেন, পরিষদের দফাদার মো. মোস্তফা কামাল, পরিষদের সদস্য মো. আবুল হাশেম, অংগজাই মারমা, স্কুল শিক্ষক মো. আবু তাহের, সাবেক মেম্বার লাব্রেচাই মারমা সহ আরও অনেকে। প্রায় ৫ কোটি টাকা মূল্যের উন্নয়ন বোর্ড হতে বরাদ্দ পাওয়া সোলার প্যানেলগুলো বর্তমানে বাটনাতলী ইউনিয়নের ছদুরখীল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একটি কক্ষে অযত্ন-অবহেলায় পড়ে আছে। সোলার প্যানেল বিতরণের তালিকায় ব্যাপক অনিয়ম-দুর্নীতির বিষয়টি সর্বমহলে জানাজানি হওয়ায়, জেলা- উপজেলা আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতৃবৃন্দ সহ সচেতন মহলের মাঝে তীব্র ক্ষোভ ও অসন্তোষ বিরাজ করছে। সোলার প্যানেল তালিকাভুক্তিতে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগের সত্যতার কথা স্বীকার করেছেন মানিকছড়ি উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মো. জয়নাল আবেদীন। অন্যদিকে বাটনাতলী ইউনিয়ন পরিষদের অভিযুক্ত জনপ্রতিনিধিরা আর্থিক দুর্নীতির দায় থেকে রক্ষা পেতে মানিকছড়ি উপজেলা আওয়ামী লীগের একজন প্রভাবশালী নেতার দারস্থ হয়েছেন, ওই নেতা মোটা অঙ্কের অর্থ গ্রহণের মাধ্যমে সোলার প্যানেল বিতরণ সংক্রান্ত আর্থিক দুর্নীতির আলোচিত ঘটনাটি ধামাচাপা দিতে পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড সহ বিভিন্ন দপ্তরে জোরালো তদবির চালাচ্ছেন মর্মে বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়। তবে সমস্ত অভিযোগ অস্বীকার করেছেন অভিযুক্ত ইউপি চেয়ারম্যান মো. আব্দুর রহিম। তিনি বলছেন, এসব অভিযোগের কোনো সত্যতা নাই। সোলার প্যানেল সংক্রান্ত দুর্নীতির সাথে আমি কোনো ভাবেই জড়িত না।