• November 21, 2024

করোনায় উম্মোচিত স্বাস্থ্যখাতের করুণ দশা

ঢাকা অফিস: দেশে করোনাভাইরাসের (কোভিড-১৯) প্রকোপ বাড়ার সঙ্গে স্বাস্থ্যখাতের অবকাঠামোগত দুর্বলতা দিন দিন আরো প্রকাশ্য হচ্ছে। ‘করোনা পরীক্ষায়’ এ খাত শেষ পর্যন্ত কতো নম্বর পাবে, তা বিশেষজ্ঞরা এখনই না বললেও নানা কারণে তাদের উদ্বেগ ও দুশ্চিন্তার শেষ নেই। বিদ্যমান অপ্রতুল অবকাঠামোর সঙ্গে দক্ষ জনবল ও চিকিৎসার দরকারি উপকরণের অভাব প্রকট হয়ে উঠছে। করোনায় আক্রান্তদের চিকিৎসায় অতি দরকারি কৃত্রিম শ্বাস-প্রশ্বাসের যন্ত্র (ভেন্টিলেটর) ও নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রের (আইসিইউ) শয্যার সংখ্যাও দেশে চরম পর্যায়ে সীমিত। ঢাকা ছাড়া দেশের অন্য কোনো জেলার সরকারি হাসপাতালে ভেন্টিলেটরের সুবিধা এখনো পর্যন্ত নিশ্চিত করা যায়নি। সূত্র: বাংলাদেশের খবর।

গত কয়েক বছর চিকিৎসক নিয়োগে অব্যাহত ‘রেকর্ড’ হলেও করোনায় চিকিৎসার জন্য ঢাকার বাইরের কয়েকটি হাসপাতাল পরিচালনা করতে হচ্ছে ‘ধার করা চিকিৎসকদের’ নিয়ে। দেশে এখন চালু হওয়া করোনা শনাক্তের ১৪টি কেন্দ্র্রে (ঢাকায় ৯টি ও ঢাকার বাইরে ৫টি) দৈনিক কমপক্ষে চার হাজার নমুনা পরীক্ষার সক্ষমতা আছে। অথচ পর্যাপ্ত লোকবল না থাকায় প্রতিদিন পরীক্ষা হচ্ছে অনেক কম। পরীক্ষার কিটের সঙ্কটও নেই। দেশে এক লাখ কিট চলে এসেছে এবং আরও কিছু আসার পথে আছে বলে গতকাল সোমবার জানান স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণমন্ত্রী জাহিদ মালেক। অথচ গত ২৪ ঘণ্টায় ১৪টি ল্যাবে মাত্র ৪৬৮টি নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষা করা হয়েছে।
করোনা প্রার্দুভাবের শুরুতেই দেশের বেশিরভাগ বেসরকারি হাসপাতাল সরকারি নির্দেশ না মেনে গুটিয়ে বসে আছে। চিকিৎসার অভাবে প্রতিদিনই রোগী মারা যাচ্ছেন। বেসরকারি চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ নির্দেশ না মানলেও সরকার শুধু ‘আহবানের’ মধ্যেই এখনো পর্যন্ত আটকে আছে। কারো বিরুদ্ধেই কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। রোগটির প্রার্দুভাবের শুরুতে একাধিক সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসকদেরকেও ব্যক্তিগত সুরক্ষা পোশাকের (পিপিই) দাবিতে ধর্মঘট পালনের ঘটনা ঘটে। তাতে স্বাস্থ্যখাতের অগোছালো ও অব্যবস্থাপনার চিত্রই ফুটে উঠে বলে বিশেষজ্ঞদের অভিমত।তাদের মতে, পরীক্ষার আওতা বাড়ানোর ফলে গত দুইদিনে দেশে যেভাবে করোনা রোগী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় শনাক্ত হচ্ছে, তাতে এ ধরনের পরিস্থিতি মোকাবেলায় ভেন্টিলেটরের সংখ্যা খুবই উদ্বেগের। কোভিড-১৯ রোগে আক্রান্তদের পরিস্থিতি খারাপ হয়ে উঠলে, বা রোগটি আরো ছড়ালে পরিস্থিতি সামাল দেয়া কঠিন হয়ে পড়তে পারে বলে তাদের আশঙ্কা। বিজ্ঞানভিত্তিক ধারণার পরিপ্রেক্ষিতে কেউ কেউ দেশে অন্তত এক কোটি ৬০ লাখ (১০ শতাংশ) মানুষের করোনা সংক্রমণের আশঙ্কা করছেন। মোট জনসংখ্যার ১ শতাংশের অর্ধেক (সাড়ে ৮ লাখ) আক্রান্ত হলেও হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসা দেওয়ার কোনো সক্ষমতা থাকবে না বলে তারা উদ্বেগ প্রকাশ করছেন।

অভিযোগ আছে, আওয়ামী লীগের নেতৃত্বের টানা তৃতীয় মেয়াদের সরকারের সময় গত ১১ বছরে স্বাস্থ্যখাত অন্য কয়েকটি খাতের সঙ্গে সমানতালে এগিয়ে যেতে পারেনি। গত ১১ বছরে সরকার নতুন চিকিৎসাকেন্দ্র ও বিশেষায়িত হাসপাতাল নির্মাণের পাশাপাশি সারা দেশের জেলা সদর হাসপাতাল ও উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে শয্যার সংখ্যা বাড়ানোসহ রেকর্ডসংখ্যক চিকিৎসক ও সেবিকা নিয়োগ দিলেও স্বাস্থ্যখাত প্রয়োজনের তুলনায় এখনো পিছিয়ে আছে। গত প্রায় ১৫ বছর ধরে এ খাতে মোট বাজেটের তুলনায় বরাদ্দ কমছে। মোট বাজেটের মাত্র ৪ থেকে ৫ শতাংশ এ খাতের জন্য বরাদ্দ থাকছে। দেশের স্বাস্থ্য খাতে জিডিপির অন্তত ৫ শতাংশ বরাদ্দের দাবি থাকলেও গত অর্থবছরের বাজেটে হয়েছে ১ শতাংশেরও কম।

মুঠোফোনে যোগাযোগ করলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) সাবেক উপাচার্য ডা. নজরুল ইসলাম গতকাল সন্ধ্যায় এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশের খবরকে বলেন, ‘করোনায় আক্রান্ত সব রোগীকে আইসিইউতে রাখার প্রয়োজন না-ও হতে পারে। আবার ১০ থেকে ২০ শতাংশকে আইসিইউতে রাখার দরকার হতে পারে। রোগটিতে আক্রান্তদের শ্বাসকষ্ট হয় বলে চিকিৎসার জন্য অনেকের ভেন্টিলেটর লাগে। সেই তুলনায় আমাদের ভেন্টিলেটর সক্ষমতা নেই।’
করোনা পরিস্থিতি মোকাবেলায় দেশে জরুরি ভিত্তিতে আইসিইউ ও ভেন্টিলেটর বাড়ানোসহ প্রয়োজনের চেয়ে বেশি প্রস্তুত রাখার ওপর জোর দেন তিনি। তার মতে, ‘যথাযথ প্রস্তুতি না থাকলে সামনের দিনগুলোতে করোনা মহাবিপর্যয়ের আশঙ্কা তৈরি করতে পারে।’

অভিযোগ উঠেছে, বৈশ্বিক মহামারী করোনা ধেয়ে এলেও স্বাস্থ্যখাতে বিনিয়োগ করতে কয়েকটি মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ কর্মকর্তাদের প্রচণ্ড রকম দ্বিধা দেখা যায়। মরণঘাতী ভাইরাসটির প্রতিরোধে শুধু জনগণের সচেতনতা বাড়াতে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় ১০০ কোটি টাকা বরাদ্দের দাবি জানালেও এখনো পর্যন্ত চিকিৎসাখাতে বরাদ্দ মাত্র ৫০ কোটি টাকা। যা বর্তমান পরিস্থিতিতে ‘চরম হতাশার বার্তা দেয়’ বলে জনস্বাস্থ্যবিদরা মনে করেন। তবে যে বরাদ্দ স্বাস্থ্যখাতের জন্য সাধারণত থাকে, এরও যথাযথও বাস্তবায়ন অপচয়, অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে হয় না বলেও ব্যাপক অভিযোগ আছে। ধারাবাহিকভাবে অনিয়ম চলতে থাকায় প্রত্যাশিত উন্নয়ন না হওয়ার কারণেও আজকের করোনা পরিস্থিতিতে স্বাস্থ্যখাতের নানা বেহাল দিকের কথা মানুষের আরো জানাজানি হচ্ছে।

বিশেষজ্ঞরা জানান, কোভিড-১৯ রোগে আক্রান্তদের অবস্থা সঙ্কটাপন্ন হলে এক পর্যায়ে তাদের চিকিৎসার বিশেষ উপকরণ হয়ে উঠে ভেন্টিলেটর। তখন এর ব্যবহার ছাড়া বিকল্প কোনো চিকিৎসার সুযোগ থাকে না। হাসপাতালে এ সুবিধাসম্পন্ন চিকিৎসার সুযোগ রাজধানীতেই সীমাবদ্ধ। দেশের বাকি ৬৩ জেলার সরকারি চিকিৎসা কেন্দ্রগুলোতে ভেন্টিলেশনের নেই। অথচ করোনা আক্রান্ত রোগী শুধু ঢাকাতেই সীমাবদ্ধ নয়, দেশের বিভিন্ন এলাকায় রোগী শনাক্ত হচ্ছে। সামনের দিনগুলোতে শুধু ঢাকাতেই রোগী সীমাবদ্ধ থাকবেন, এমনটা বলার কোনো সুযোগ নেই। গতকাল করোনায় আক্রান্ত রোগী শনাক্ত ও মৃতের সংখ্যা আগের রেকর্ড ছাড়িয়েছে। এমন পরিস্থিতি বিশেষজ্ঞ ও আক্রান্তসহ দেশের সচেতন জনগোষ্ঠী উদ্বিগ্ন।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানায়, সারা দেশে করোনা রোগীদের চিকিৎসা দেওয়ার জন্য সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতাল মিলিয়ে মোট চার হাজার ৫১৫টি ‘আইসোলেশন’ শয্যা প্রস্তুত আছে। শুধু ঢাকাতেই প্রস্তুত এক হাজার ৫০টি। ঢাকার মোট পাঁচটি হাসপাতালে এ ইউনিট গড়ে তোলা হয়েছে। এ পাঁচটি হাসপাতালে মোট ২৯টি ভেন্টিলেশন সুবিধা আছে। করোনা রোগীর চিকিৎসায় এখন পর্যন্ত ঢাকার বাইরে কোনো আইসোলেশন ইউনিটে কোনো ধরনের ভেন্টিলেশন সুবিধা দেওয়া হয়নি।
তথ্যমতে, গত ৬ জানুয়ারি ঢাকায় আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক ২০২০ সালে ‘মুজিববর্ষ’ (জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ) উপলক্ষে দেশের সব সরকারি হাসপাতালের আইসিইউ শয্যা দ্বিগুণে উন্নীত করার কথা জানিয়েছিলেন। সঙ্কট সমাধানে আগামী ২০২২ সালের মধ্যে প্রতিটি জেলায় অন্তত পাঁচটি করে আইসিইউ শয্যা নির্মাণের আশ্বাস চলতি বছরের শুরুতে দেয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরও। এসব লক্ষ্যে কাজ শুরুর আগেই গত ৮ মার্চ দেশে প্রথম করোনার রোগী শনাক্ত হন। এরপর ধীরে ধীরে চিকিৎসা ব্যবস্থা করোনা প্রতিরোধের দিকে ধাবিত হওয়ায় থেমে যায় অন্য কার্যক্রম। ফলে আইসিইউর সেই সঙ্কট রয়েই যাচ্ছে। তবে বর্তমানের পরিস্থিতি সামাল দিতে আইসিইউ বাড়ানোর চেষ্টাও করছে অধিদপ্তর। দেশের আটটি বিভাগের ১১টি হাসপাতালে চলতি সপ্তাহের মধ্যে আইসিইউ সুবিধা বাড়াতে গত ৩ এপ্রিল প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা’র (ডব্লিউএইচও) নির্ধারিত মান অনুযায়ী, কোনো দেশের হাসপাতালে রোগীর জন্য যত শয্যা থাকবে, সেগুলোর মধ্যে ১০ শতাংশ আইসিইউ থাকতে হয়। তা সম্ভব না হলে ন্যূনতম ৪ শতাংশ আইসিইউ থাকতে হবে। দেশের সরকারি হাসপাতালগুলোয় সব মিলিয়ে রোগীর শয্যা রয়েছে ৩১ হাজার ২২০টি। এ অনুযায়ী চিকিৎসাকেন্দ্রগুলোতে আইসিইউ ও ভেন্টিলেটর থাকার কথা সাড়ে তিন হাজারেরও বেশি। ন্যূনতম ধরলেও এর সংখ্যা হওয়ার কথা ছিল বারো শতের মতো।

উদ্বেগজনক হচ্ছে, সরকারি সব হাসপাতাল মিলিয়ে বর্তমানে আইসিইউ আছে মাত্র ২২১টি। সব আইসিইউতে আবার ভেন্টিলেশনের সুবিধা নেই। জেলা পর্যায়ের ১৮টি সরকারি হাসপাতালে আইসিইউর কোনো ইউনিটই নেই। আবার আইসিইউ থাকলেও সেবা নিশ্চিতের জন্য নেই অনেক হাসপাতালে দক্ষ ও প্রশিক্ষিত জনবল। ভেন্টিলেটরসহ ও আইসিইউ তুলনামূলক অনেক দামি যন্ত্র হলেও তা সরকারের সামর্থের বাইরে নয়। পরিস্থিতি সামাল দিতে তাই আগেভাগেই প্রস্তুতি নিতে সরকারের প্রতি আহবান বিশেষজ্ঞদের।

এইচএস/এএইচএমএফ

পাহাড়ের আলো

https://pahareralo.com

সর্বাধিক জনপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল। সর্বশেষ সংবাদ সবার আগে জানতে চোখ রাখুন পাহাড়ের আলোতে।

Related post