করোনায় দেশজুড়ে সেনাবাহিনীর প্রশংসনীয় উদ্যোগে জনমনে সন্তোষ
মো. সাইফুল ইসলামঃ বিশ্বব্যাপী মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়া করোনা ভাইরাস বর্তমানে বাংলাদেশে সংক্রমণ এবং বিস্তৃতির ঝুঁকি বিবেচনায় সরকারের সশস্ত্র বাহিনী মোতায়েনের সিদ্ধান্তের প্রেক্ষিতে গত ২৪ মার্চ মঙ্গলবার প্রয়োজনীয় সমন্বয়ের পর ২৫ মার্চ বুধবার থেকে মাঠ পর্যায়ে কাজ করছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। গত ২৬ মার্চ বৃহস্পতিবার সেনাবাহিনী দেশের সর্বত্র করোনা ভাইরাস নিয়ন্ত্রণে স্থানীয় প্রশাসনের সাথে একযোগে কাজ করেছে। জেলা ম্যাজিস্ট্রেট এর সমন্বয়ে সেনাবাহিনী বিভাগীয় ও জেলা শহর গুলোতে সামাজিক দূরত্ব ও সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সাধারণ জনগণকে উৎসাহিত করছে তারা; পাশাপাশি তারা বিদেশ ফেরত ব্যক্তিদের বাধ্যতামূলক কোয়ারান্টিন এ রাখার বিষয়টিও পর্যবেক্ষণ করছে।
বর্তমানে সারাদেশের প্রায় সব জায়গায় জনকল্যাণমুখী এই কার্যক্রমে সেনাবাহিনীর সেনাসদস্যগণ দায়িত্ব পালন করছে। তারা মাঠ পর্যায়ে স্থানীয় জনসাধারণকে করোনার প্রাদুর্ভাব সম্পর্কে মাইকিং করে বুঝিয়ে, সচেততনতা সৃষ্টি করে ঘরে ফেরাতে তৎপর, পাশাপাশি সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিতসহ সারাদেশে কর্মহীন, দুঃস্থ ও অসহায়দের জন্য সরকারের ত্রাণ তহবিলে নিজেদের একদিনের বেতন জমা করাসহ কর্মহীনদের মাঝে ত্রাণ বিতরণ করে যাচ্ছে।
বিভিন্ন জেলার গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলোতে অবস্থান করে ও মাইকিংয়ের মাধ্যমে করোনার বিরুদ্ধে সবচাইতে কার্যকর পদ্ধতি ‘সামাজিক দূরত্ব’ সৃষ্টিতে সহায়তা করে আসছে সেনাবাহিনী। এ ছাড়াও গুরুত্বপূর্ণ সড়ক ও স্থাপনায় জীবাণুনাশক পানি স্প্রে, বিভিন্ন স্থানে হাত ধোয়ার ব্যবস্থাপনা তৈরি এবং স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে সমন্বিতভাবে আরো বেশ কিছু কার্যক্রম পরিচালনা করছে সেনাবাহিনী। বিভিন্ন স্থানে জনসচেতনতা সৃষ্টিতে পায়ে হেঁটে প্ল্যাকার্ড নিয়ে মানুষের ঘরে ঘরে ছুটে যাচ্ছে সেনাবাহিনীর সদস্যরা। সেখানে কারো হাতে থাকা প্ল্যাকার্ডে লেখা ‘ঘনঘন হাত ধুই, করোনা থেকে নিরাপদ রই’। অপর এক প্ল্যাকার্ডে লেখা ‘বিদেশ থেকে এসেছি যারা, কোয়ারেন্টাইনে থাকব তারা’। এ ছাড়াও করোনা নিয়ে আতঙ্ক সৃষ্টি না করার আহ্বান জানিয়ে লেখা অন্য এক প্ল্যাকার্ডে বলা হয়েছে ‘আতঙ্ক না ছড়াই, সতর্ক থাকি সাহায্য করি’। এছাড়া সেনাবাহিনীর সদস্যরা করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তিবর্গের তালিকা প্রস্তুত এবং বিদেশ হতে প্রত্যাগত ব্যক্তিবর্গের কোয়ারেন্টাইনে থাকা নিশ্চিতকল্পে স্থানীয় প্রশাসন কর্তৃক গৃহীত পদক্ষেপ সমূহে সহায়তা ও সমন্বয় করছে। বিভাগ এবং জেলা পর্যায়ে প্রয়োজনে মেডিকেল সহায়তাও প্রদান করছে তারা।
বাংলাদেশ সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদের সার্বিক দিক-নির্দেশনায় সারাদেশের সকল জেলা, উপজেলা, ইউনিয়ন ও ওয়ার্ড পর্যায়ে বিচরণ করে ইতিমধ্যেই সেনাবাহিনী নিজেদের কর্মকান্ডগুলোর জন্য সর্ব মহলে সুনাম কুঁড়িয়েছে। শুধু বাংলাদেশে নয়, জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনেও বাংলাদেশের সেনাবাহিনী গৌরবজ্জ্বল ভূমিকা পালন করছে। অধিকাংশ শান্তি মিশনগুলোতে সেনাবাহিনীর অনেকটা জনকল্যাণমুখী কাজেই বাংলাদেশের করোনা মোকাবেলায় সেনাবাহিনীকে মোতায়েন করা একটি ইতিবাচক সিদ্ধান্ত বলে সাধারণ মানুষ মনে করছে। এর আগেও বিভিন্ন সময় বন্যা, সাইক্লোন ও ঘুর্ণিঝড়সহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলায় সেনাবাহিনীকে ব্যবহার করা হয়েছিল এবং সেই দায়িত্ব সফলভাবে পালন করেছে তারা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সেনাবাহিনীকে দায়িত্ব দেয়ার ফলে জনমনে স্বস্তি হবার প্রধান কারণ হলো- প্রথমত, জনগণ মনে করে যে সেনাবাহিনী কারো প্রতি অনুরাগ-বিরাগের বশবর্তী হয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নেয় না; বরং নিয়ম-নীতি অনুযায়ী নির্মোহভাবে কাজ করে। দ্বিতীয়ত, সিভিল প্রশাসন বা অন্য বাহিনীর লোকজনের নির্দেশনা সাধারণ মানুষরা শুনতে চায়না, নির্দেশ অমান্য করতে চায়। কিন্তু সেনাবাহিনীর ক্ষেত্রে সাধারণত তেমনটি করেনা। তৃতীয়ত, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একটি সুন্দর ইমেজ রয়েছে যে, তারা সৎ-নির্ভীক এবং দেশপ্রেমিক। তাই তাদের উপর সাধারণ মানুষের আস্থা আর বিশ্বাস বেশি।
সাধারণ মানুষ অনেকেই মনে করছে, যথাযথ সময়ে সেনাবাহিনীকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। এর ফলে বাংলাদেশ করোনা মোকাবেলার ক্ষেত্রে একটি বড় ইতিবাচক পদক্ষেপ গ্রহণ করলো বলে মনে করছে তারা। রাজধানীর বিমান বন্দর সংলগ্ন আশকোনা হাজী ক্যাম্পও হোম কোয়ারেন্টাইন হিসেবে বর্তমানে সেনাবাহিনী কর্তৃক পরিচালিত হচ্ছে। সেনাবাহিনীর হাতে এ কাজের দায়িত্ব দেয়ায় করোনাভাইরাস সংক্রমণ ও বিস্তৃতি প্রতিরোধে সঠিক পদক্ষেপ নেয়া সম্ভব হবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা ও সাধারণ নাগরিকরা।
বিশ্বে করোনা পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করার পর বিদেশ থেকে দেশে ফিরেছেন হাজারো প্রবাসী। সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী তাদের ১৪ দিন কোয়ারেন্টাইন বা ঘরে থাকার নির্দেশনা দেয়া হলেও তা ঠিক ভাবে অনেক ক্ষেত্রে মানা হচ্ছে না। স্থানীয় প্রশাসন এবং স্বাস্থ্য বিভাগের তথ্যমতে, দেশের বিভিন্ন জেলায় হাজারেরও বেশি প্রবাসী ফিরে এসেছেন। তবে তাদের মধ্যে খুব কমই রয়েছেন হোম কোয়ারেন্টাইনে। অনেক জায়গায় এ সংখ্যা ডজনেরও কম। এতে করে স্থানীয় পর্যায়ে করোনার ভয়াবহ বিস্তার ঘটতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা। কারণ জাতীয় রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) তথ্যানুযায়ী এখন পর্যন্ত দেশে আক্রান্তদের অধিকাংশ বিদেশ থেকে আসা আত্মীয়ের মাধ্যমে সংক্রমিত হয়েছেন। তবে জেলা পর্যায়ে সেনাবাহিনীর সহায়তায় এই বিষয়ে যথেষ্ট সমন্বয় করা হয়েছে। বিদেশ থেকে যারা এসেছেন এবং তাদের মাধ্যমে সম্ভাব্য সংক্রমণকারীদের আলাদা করে হোম কোয়ারেন্টাইনে রাখা হয়েছে। সেনাবাহিনীর সহায়তা ছাড়া এই পদক্ষেপ বাস্তবায়ন করা কঠিন হতো।
সাধারণ জনগনের অনেককেই মন্তব্য করতে শোনা যায়, সেনাবাহিনীকে এ দায়িত্ব দেয়ায় এক দিকে মানুষের মধ্যে করোনাভাইরাস সংক্রমণ কম হবে, অন্যদিকে যারা কোয়ারেন্টাইনে থাকবেন তাদের যথাযথ প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা সম্ভব হবে। কোয়ারেন্টাইনে থাকা নিয়েও কেউ কোন অভিযোগ করার সুযোগ পাবেন না। কারন অতীতে যে কোন দুর্যোগে সেনাবাহিনী তাদের দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে দেশের সাধারন মানুষের আস্থা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে। এবারও এর ব্যতিক্রম হবে না বলে তারা মন্তব্য করেন।
করোনাভাইরাসের সংক্রমণ প্রতিরোধে সারাদেশে বিরামহীনভাবে কাজ করছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। উদ্ভূত সংকট মোকাবিলায় বেসামরিক প্রশাসনের সাথে সমন্বয় করে তারা কাজ করছেন। সামাজিক দূরত্ব ও জনসচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে বিশেষভাবে চালাচ্ছেন প্রচার-প্রচারণা। পাশাপাশি হ্যান্ড মাইকে জানাচ্ছেন, অহেতুক ঘোরাফেরা না করে ঘরে থাকতে। চায়ের দোকানে আড্ডা না দিতে ও পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন থাকতে।
জানা গেছে, দেশের সর্বত্র সেনা সদস্যরা জননিরাপত্তায় দিনরাত কাজ করছেন, সচেতন করছেন উদ্ভূত করোনাভাইরাস পরিস্থিতি নিয়ে। বলছেন জনসমাগম এড়িয়ে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে। সংক্রমণ এড়াতে বিশেষে মাইকিং ছাড়াও, সচেতনতামূলক লিফলেট বিতরণ, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা, দোকান-বসতবাড়িতে জীবাণুনাশক স্প্রে করা, মাস্ক ও সাবান প্রদান, বিদেশ ফেরতদের কোয়ারেন্টিন নিশ্চিত করা ও খাদ্যসামগ্রী প্রদানসহ নানা কর্মযজ্ঞ পরিচালনা করছে সেনাবাহিনী।
ইতোমধ্যে তাদের এই কার্যক্রমে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন দেশের সাধারণ মানুষ। তারা বলছেন, সেনা সদস্যদের বিনয়ী আচরণে দেশবাসী সচেতন হয়ে যাচ্ছেন করোনাভাইরাস নিয়ে। এভাবে চলতে থাকলে খুব শিগগিরই সবাই স্বাভাবিক জীবন যাত্রায় ফিরতে পারবে। সারাদেশে কর্মরত বিভিন্ন পর্যায়ের সেনা কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলাপে জানা গেছে, দেশবাসীকে করোনাভাইরাস সংক্রমণ থেকে বাঁচাতে নিরলসভাবে পরিশ্রম করছেন তারা। পরিস্থিতি অনুকূলে না আসা পর্যন্ত তাদের এই কার্যক্রম অব্যাহত থাকবে।
সেনাবাহিনীর দায়িত্বপ্রাপ্ত ইউনিট অধিনায়কগণ জেলা প্রশাসন, পুলিশ প্রশাসন ও সিভিল সার্জনদের সঙ্গে সমন্বয় সাধন করে কাজ করছেন. সেনা মেডিকেল অফিসারগণ ঐ সমন্বয় দলের সঙ্গে থাকছেন। সেনাবাহিনীর পাঠানো সমন্বয় দলগুলো বিদেশ থেকে আসা ব্যক্তিদের কোয়ারেন্টাইন কর্মসূচি নিশ্চিত করতে জেলা প্রশাসকদের সমন্বয়ে একটি কার্যকর পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। বাংলাদেশে করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতে মানুষকে ঘরে রাখার জন্য লকডাউনের দ্বিতীয় সপ্তাহে এসে গত ২রা এপ্রিল বৃহস্পতিবার থেকে সেনাবাহিনীসহ নিরাপত্তাবাহিনীর তৎপরতা জোরদার করা হয়েছে।
দেশের কোথাও কোথাও সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে জনসচেতনতা পাশাপাশি অসহায় ও দুস্থদের মধ্যে চাল, ডাল, আলু, লবণ ও তেলসহ বিভিন্ন নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রী বিতরণ করা হয়েছে।
সম্প্রতি করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব ঠেকাতে ও জনসাধারণকে সচেতন করতে মাঠে থাকা সেনাবাহিনীর এক সদস্যের এক বৃদ্ধকে মাস্ক পরিয়ে ত্রাণের প্যাকেট দিয়ে বুঝিয়ে বাড়িতে ফেরত পাঠানোর ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে.
বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়া ও অসংখ্য মানুষের মৃত্যু ঘটানো এই করোনা ভাইরাস বাংলাদেশে সর্বপ্রথম গত ৮ই মার্চ শনাক্ত হয় একজন রোগীর দেহে। এরপর থেকে সরকার এর সংক্রমণ এড়াতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষনা, গণ পরিবহণ বন্ধ, গার্মেন্টস-কলকারখানা বন্ধ ও অফিস-আদালত বন্ধ ঘোষনাসগ নানা পদক্ষেপ ও কার্যকরী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেও গত ২৪শে মার্চ সংবাদ সম্মেলন ও সরকারী প্রজ্ঞাপন জারি করে দেশের সব জায়গায় করোনার প্রাদুর্ভাব ঠেকানো, সামাজিক দূরত্ব বজায়সহ করোনার প্রাকোপ থেকে দেশবাসীকে রক্ষা করতে বেসামরিক প্রশাসনকে সহায়তা করতে সারাদেশে সেনা মোতায়নের সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। এরপর থেকেই দেশ সেবার বাসনা নিয়ে করোনা আতঙ্ককে পেছনে ফেলে দেশের জণগনকে করোনার সংক্রমণ থেকে বাঁচাতে মাঠে নামে সেনাবাহিনী। গত পহেলা এপ্রিল বুধবার সেনাপ্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদ সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, সেনাবাহিনী প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে কাজ করছে। যত সেনা সদস্যের প্রয়োজন তিনি তা দেবেন। তিনি বলেন, করোনাভাইরাসের কারণে বিশেষ পরিস্থিতিতে যতদিন প্রয়োজন হবে, সেনাবাহিনী ততদিন মাঠে থাকবে। সাধারণ মানুষের ভরসা আর নির্ভরতার প্রতিক সেনাবাহিনী প্রতিবারের মতো এবারও দেশের সঙ্কট মুহূর্তে জনগনকে বিপদমুক্ত করতে সক্ষম হবে এই আশা সকলের।