চার বছর ধরে শিকলে বাঁধা মেহেদী
বিশেষ প্রতিবেদক: মহালছড়ি সদর ইউপির মোহাম্মদপুর এলাকায় চার বছর ধরে পুকুরপাড়ে পায়ে শিকল বেঁধে বন্ধী করে রেখেছে মেহেদী হাসান(২৮) নামে এক যুবককে। অষ্টম শ্রেণীতে পড়া অবস্থায় সে হঠাৎ করে মানসিক প্রতিবন্ধী হয়ে পড়ে। এরপর থেকে এই অবস্থায় আছেন তিনি। তার মা বকুল খাতুনও প্রায় ১৪ বছর ধরে মানসিক প্রতিবন্ধী হয়ে আছেন।
মেহেদী হাসানকে যে পুকুরপাড়ে শিকল দিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছে সেখানেই তার পরিবারের বসবাস। ছোট্ট একটি কুড়ে ঘরে থাকেন তারা। তাদের জন্য যেনো সরকারের কোনো বরাদ্দ নেই। এদিকে তার বাবা কেনান মিয়া মা ছেলের চিকিৎসা চালাতে গিয়ে নিজের যে সম্পত্তি ছিলো সব বিক্রি করার পরও তাদের সুস্থ করতে পারেন নি। এখন পরিবার নিঃস্ব হয়ে পড়ে আছে। নেই তাদের নামে প্রতিবন্ধরী বাতার কার্ড। রোদ, বৃষ্টি যাই হোক এই খোলা আকাশের নিছে বসবাস এই মেহেদী হাসানের। কোনোভাবেই তাকে ঘরে রাখা সম্ভব হয়না। এবং কোনো ছাউনির নিছেও সে থাকেন না। পুকুরপাড়ে শিকল বাঁধা অবস্থায় সে দিন রাত পার করেন।
তার বাম পায়ে লোহার শিকল পেঁচিয়ে তালা মেরে দেওয়া হয়েছে। অপরদিকে পুকুরপাড়ে একটি পিলারের সাথে আটকে রাখা হয়েছে শিকল। একই জায়গায় ঝড়, তুপান, বৃষ্টির মাঝেও খোলা আকাশের নিছে জীবন পার করছেন তিনি। সেখানে নেই কোনো খাট বা থাকার ব্যবস্থা। মানসিক ভারসাম্য হারানোর পর চার বছর ধরে একইভাবে আছেন তিনি। মেহেদীর বাবা কেনান মিয়া নদীতে মাছ ধরে বাজারে এনে বিক্রি করে সেই টাকা দিয়ে এখন সংসার চালাচ্ছেন। বাহিরের কাজ শেষে আবার বাসায় এসে রান্না করে মা ছেলেকে খাওয়াতে হয় তার। এই যেনো এক কঠিন জীবন যুদ্ধ। পরিবারের লোকজন বিভিন্ন মাধ্যমে সমাজসেবা অফিসে গিয়ে তাদের জন্য তদবির করলেও মা ছেলের ভাগ্য জোটেনি প্রতিবন্ধী কার্ড। হয়নি তাদের ভোটার আইডিও। এগুলো করতে গিয়ে শুধু ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে তাদের পক্ষে কাজ করা লোকদের।
মেহেদি হাসানের মামা মোঃ শাহিদুল ইসলাম জানান, আমার বোন ও বাগিনা দুজনই মানসিক প্রতিবন্ধী। তাদের পরিবারের অবস্থা খুবই খারাপ। ভাগিনা হঠাৎ করে অষ্টম শ্রেণীতে পড়ার সময় মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন। আর্থিক সার্মথ্য অনুযায়ী চিকিৎসা করানোর পরও সুস্থ হয়নি। ৪ বছর ধরে এভাবেই পুকুর পাড়ে জীবন পার করেছে। কোন সহযোগিতা আমরা পাইনি। আমার ভাগিনা ও বোনের চিকিৎসা করাতে গিয়ে পুরো পরিবার এখন নিঃস্ব। তাদের মাথা গোঁজার মতো ঠাঁই নেই।
তিনি আরো বলেন, মানসিক ভারসাম্য হারানোর পর অনেকদিন শিকল ছাড়া ছিলো। তখন সে মানুষের সাথে হঠাৎ করে মারামারি করে। খোলা থাকার সময় বাজারে মারামারি করে দুজনের মাথা ফাটিয়ে দিয়েছে। তাদেরকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিলো। এ ঘটনায় মামলা হয়। এরপর লোকজন জোর করে তাকে লোহার শিকলে বেঁধে রাখে এই পুকুরের পাড়ে। বৃষ্টিতেও এখানে ,তুফানেও এখানে ,রোদেও এই পুকুর পাড়ে থাকে। পুকুর পাড়ে টিনের ছাউনি ছিল খাট ছিল সেগুলো সে( মেহেদি হাসান) পানিতে ফেলে দিয়েছে। এখন এভাবে থাকছে।
এসময় তিনি অভিযোগ করে বলেন, সমাজসেবা অফিস তাদেরকে কোন সহযোগিতা করেনি। একই পরিবারে মা ও ছেলে মানসিক প্রতিবন্ধী হলেও তারা কোন ভাতার আওতায় আসেনি। মহালছড়ির তরুণ সংগঠক জিয়া জানান, সে অষ্টম শ্রেনী পর্যন্ত ভালো করেই পড়াশোনা করেছে। তাদের ঘরবাড়ি নেই। মা ও ছেলে দুজনই মানসিক প্রতিবন্ধী। তাদের চিকিৎসার কোন ব্যবস্থা নেই। এ পর্যন্ত তারা কোন ভাতা পায়নি। সবার উচিত তাদের পাশে দাঁড়ানো। মেহেদি হাসানের মামা মোঃ ইসমাইল বলেন, আমরাও আর্থিকভাবে তেমন সক্ষম না। সরকার তাদের পুর্নবাসন করার ব্যবস্থা করলে ভালো হত। হতদরিদ্র পরিবারটি পক্ষে মা ও ছেলের চিকিৎসা করানো সম্ভব না।
মহালছড়ি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান রতন কুমার শীল জানান, সে তো প্রতিবন্ধী এবং কার্ড পাওয়ার যোগ্য। শীঘ্রই তাদের প্রতিবন্ধী কার্ড করার উদ্যোগ নেয়া হবে। আশাকরি খুব অল্প সময়ের মধ্যে তারা সুযোগ সুবিধা পাবে। মহালছড়ি সমাজসেবা অফিসার মো.শামসুল হক জানান, আমাদের প্রতিবন্ধী জরিপ কার্যক্রম আছে। প্রতিবন্ধী জরিপ কার্ড পূরণ করে চিকিৎসকের কাছে যেতে হয়। চিকিৎসক দ্বারা প্রতিবন্ধী ক্যাটগরি অনুযায়ী অর্ন্তভুক্ত হওয়ার পর উপজেলা প্রতিবন্ধী শনাক্তকরণ কমিটি যাচাই বাছাই করার পর তাদেরকে ভাতার আওতায় আনা হবে। এর আগে সম্ভব না।
খাগড়াছড়ি জেলা প্রতিবন্ধী বিষয়ক কর্মকর্তা মো. শাহজাহান বলেন,‘তাদেরকে দ্রুত রাষ্ট্র প্রদত্ত প্রতিবন্ধী সুযোগ সুবিধার আওতায় আনা হবে। আমি সরেজমিনে পরিদর্শন করে তাদেরকে সহায়তার উদ্যোগ নিব। তাদেরকে যতটুকু সম্ভব সহযোগিতা করবো আমাদের অফিস থেকে।