তিন পার্বত্য জেলায় ভূমির একক আধিপত্যে হেডম্যানরা
আবুল খায়ের, পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে ফিরে: তিন পার্বত্য জেলা রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবানে ভূমির ওপর একক আধিপত্য হেডম্যানদের। কয়েকটি পাড়া নিয়ে একটি গ্রাম গঠিত। আর কয়েকটি গ্রাম/মৌজার প্রধান হলেন হেডম্যান। তারা এলাকাটি অনেকটা রাজতন্ত্রের মতো শাসন করছে। হেডম্যানরা মারা গেলে তাদের বংশধররাই নেতৃত্বে আসেন। জমি বিক্রি করতে গেলে ক্রেতা-বিক্রেতার স্থায়ী সনদ দেন জেলা প্রশাসক বা সার্কেলপ্রধান। তবে হেডম্যানরা যা লিখে দেয় তাই বাস্তবায়ন হয়।
রাঙ্গামাটিতে ১৫৯টি মৌজায় ১৫৯ জন হেডম্যান রয়েছেন। খাগড়াছড়িতে ১২১টি মৌজায় ১২১ জন এবং বান্দরবানে ১০৯টি মৌজায় ১০৯ জন হেডম্যান রয়েছেন। তিন পার্বত্য জেলায় ৩৮৯ জন হেডম্যানের মধ্যে মাত্র তিন জন বাঙালি। তাদের মধ্যে রাঙ্গামাটির বাঘাইছড়ি উপজেলায় এক জন এবং লংগদু উপজেলায় দুই জন। রাঙ্গামাটির হেডম্যানরা চাকমা সম্প্রদায়ের। বান্দরবানে বোমাং ও খাগড়াছড়িতে মং সম্প্রদায়ই হেডম্যানের দায়িত্ব পালন করছে। তাদের কাছে অন্য সম্প্রদায়ের পাহাড়ি এবং বাঙালিরা জিম্মি হয়ে পড়েছেন। এই তিন সম্প্রদায়ের একচেটিয়া আধিপত্য বিস্তার করছে তিন পার্বত্য জেলায়। ‘কাগজ যার জমি তার’ আইন দ্রুত বাস্তবায়ন করার দাবি জানিয়েছেন অধিকাংশ পাহাড়ি-বাঙালিরা।
খাগড়াছড়ি, রাঙ্গামাটি আর বান্দরবান জেলা নিয়ে গঠিত পার্বত্য চট্টগ্রাম যেন অপরূপ নৈসর্গের এক লীলাভূমি। শান্তি ও সম্প্রীতির বার্তা নিয়ে এখানে ১২টি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী (চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, বম, মুরং, তঞ্চঙ্গ্যা, খুমী, লুসাই, খেয়াং, উষাই, পাংখু, চাক ইত্যাদি) এবং বাঙালিদের বসবাস। কিন্তু এই শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের মধ্যে ষড়যন্ত্রের বিষবাষ্প ছড়িয়ে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী-বাঙালির মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করে ফায়দা লোটার অপচেষ্টায় লিপ্ত একশ্রেণির স্বার্থান্বেষী মহল। ভূমি ব্যবস্থাপনায় মারাত্মক জটিলতা দেখা দিয়েছে সেখানে। ১৯৯৯ সালে খাগড়াছড়িতে পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন গঠিত হয়। এরপর রাঙ্গামাটিতে ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে ও বান্দরবানে ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে কমিশনের শাখা কার্যালয় খোলা হয়। কিন্তু মাঠ পর্যায়ের সব কিছুর নিয়ন্ত্রণ এখনো হেডম্যানদের হাতে। হেডম্যানরা যা লিখে দেয় তাই বাস্তবায়ন হয়। সব কর্তৃত্ব ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর কয়েকটি সম্প্রদায়ের হাতে, যারা শান্তিচুক্তি করেও এর বিরোধিতা করে আসছে। তারা যেন বড় ক্ষমতাধর। এ প্রেক্ষিতে সরকার আইন করতে যাচ্ছে যে, দলিল যার, জমি তার। সিংহভাগ পাহাড়িদের দাবিও এটি। পাহাড়ি-বাঙালিরা বলেন, হেডম্যানদের কারণে তারা প্রতিহিংসার শিকার হচ্ছেন। হেডম্যান প্রথার কোনো দরকার নেই। দেশের অন্যান্য জেলার মতো পার্বত্য তিন জেলায়ও ভূমি ব্যবস্থাপনা থাকা উচিত। দ্রুত ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি হওয়া প্রয়োজন। এদিকে তিন সার্কেল চিফের মধ্যে এক জন আছেন মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছিলেন, তিনি অবৈধভাবে অর্থ-সম্পদ অর্জন করে দেশবিরোধী কাজে বিভিন্ন দেশে লবিস্ট নিয়োগ করে আসছে।
পার্বত্য তিন জেলায় জমি নিয়ে সমস্যার শিকড় গভীরে। সত্তর দশকের মাঝামাঝি থেকে প্রায় দুই যুগ ধরে সরকারের সঙ্গে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (জেএসএস) তথা শান্তি বাহিনীর সংঘাত চলেছে। সে সময় তিন পার্বত্য জেলার ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর অনেকে ভারতে শরণার্থী হন। অনেকে আবার অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তুতে পরিণত হন। ১৯৭৯ সাল থেকে দু-তিন বছরে সরকার আড়াই থেকে সাড়ে ৪ লাখ ভূমিহীন-নদীভাঙনের শিকার বাঙালিকে পার্বত্য চট্টগ্রামে নিয়ে আসে। সরকার তাদের জমি দেয়। সরকারের সঙ্গে জেএসএসের শান্তি আলোচনার পথ ধরে ১৯৯০-এর দশকের মাঝামাঝি ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মানুষ নিজ ঘরে ফেরা শুরু করেন। জমির মালিকানা নিয়ে পালটাপালটি দাবি তোলে বাঙালি ও ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মানুষ। ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মানুষ বলছে, জমি তাদের। তাদের কাছে বন্দোবস্তের কাগজ আছে। একাধিক আইনে তাদের ভোগদখলি ও প্রথাগত অধিকারের স্বীকৃতি আছে। বাঙালিরা বলছে, তারা সরকারের কাছ থেকে এসব জমি খাস হিসেবে পেয়েছেন। তাদের কাছেও কাগজ আছে। ফলে জমির প্রকৃত মালিকানা কাদের, তা বের করাও জটিল। তিন পার্বত্য জেলায় অনেক বাঙালি পরিবার রয়েছে, তাদের পূর্বপুরুষের এখানেই জন্মভূমি। তারাও ভূমি নিয়ে নিদারুণ বৈষম্যের শিকার। এ অবস্থায় ১৯৯৭ সালে হয় পার্বত্য চুক্তি। চুক্তি অনুযায়ী, ঐ অঞ্চলের ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য সরকার ১৯৯৯ সালে প্রথম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন গঠন করে। কিন্তু এই কমিশন মূলত হেডম্যানদের কথাই শোনে। সূত্র: দৈনিক ইত্তেফাক।