পাহাড়ে বিলুপ্তির পথে ঐতিহ্যবাহী শন!
এম.সাইফুল ইসলাম: পাহাড়ে হারিয়ে যাচ্ছে ঐতিহ্যবাহী শনের ঘর। এ ঘরের কদর বর্তমান যুগের ইট-পাথর আর টিনের ব্যবহারের ফলে প্রায় বিলুপ্ত। অথচ কয়েকবছর আগেও পার্বত্যাঞ্চলের প্রতিটি পাড়ায় পাড়ায় দেখা যেত নজর কাঁড়া শনের ঘর। শুধু বসত বাড়িই নয়, ছিল ধান-চাল রাখার জন্য শনের তৈরী গোলা ঘর ও কুঠি। তবে দিন দিন পাহাড়ে অতিমাত্রায় আধুনিকতার ছোঁয়া ও ইট- টিনের ব্যবহারের কারণে আজ হারাতে বসেছে ঐতিহ্যবাহী শনের ঘর ।
এই ঘর সব মৌসুমে আরামদায়ক ও ঠান্ডা থাকায় এক সময় এটাকে গরীবের শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ঘরও বলা হতো। এ ঘর গরমের সময় আরামদায়ক। তাই অনেক পাড়াতে পাহাড়ী বিত্তশালীদেরও শনের ঘর ছিল। এখনও এ অঞ্চলের অনেক পাড়াতে রয়েছে এ ঘর।
কনের সহজলভ্যতা, বাঁশের ব্যবহার, প্রয়োজনীয় উপকরণ আর শ্রমিক খরচ কম হওয়ায় আগের দিনে মানুষ শনের ঘর বানাতে বেশী আগ্রহী ছিল। প্রাকৃতিক দূর্যোগ তেমন কোন ক্ষতিই করতে পারেনা শনের ঘরের তাই অনেকাংশেই নিরাপদ এ ঘর।
এদিকে পাহাড়ে প্রাকৃতিক ভাবে উৎপাদিত শন (তৃণ) এখন ঘরের চাউনি হিসেবে আর ব্যবহার হয় না। সচরাচর দেখা যায় না শনের চাউনির ঘর। কেউ চাউনি হিসাবে শন ব্যবহার করতে চাইলেও সংগ্রহ অত্যন্ত কষ্টসাধ্য।
গ্রামীণ জনপদের বসবাসকারী প্রবীণজনেরা বলছেন, শনের চাউনির ঘর সব ঋতুতেই স্বস্তির। গ্রীষ্মে ঘর থাকে শীততপ নিয়ন্ত্রিত ঘরের মত। তারা বলেছেন, আগে পাহাড় টিলায় প্রাকৃতিক ভাবে শন উৎপাদন হতো। এখন সরকারি-বেসরকারি মালিকানায় থাকা সব পাহাড় টিলায় ঝোপ-ঝাড় পরিস্কার করে লাগানো হয় ফলজ-বনজ গাছ। যুগের চাহিদা পূরণে গাছপালা লাগাতে গিয়ে শনের মত তৃণ জাতিয় উদ্ভিদের মূল উৎপাঠন করে ফেলার প্রবণতায় পাহাড় টিলা থেকে শন নামের প্রাকৃতিক এই উদ্ভিদ বিলুপ্ত হয়ে গেছে। তারা বলেছেন, দুই যুগ আগেও পাড়া গ্রামের হাট বাজার গুলোতে শনের পাহাড়সম স্তুপ দেখা যেতো। ছোট ছোট আঁটিতে বিক্রি হতো শ অথবা হাজার হিসাবে শনের আঁটি। অনেকেই শনের ব্যবসা করে জীবিকা নির্বাহ করতো। শ্রমজীবিরা পাহাড় টিলা থেকে শন সংগ্রহ করে বিক্রির জন্য কাধে ভাঁড় নিয়ে আসতো বাজারে। গ্রামীণ অধিকাংশ মানুষ মাটি ও বাঁশের বেড়ায় তৈরী ঘরের চালায় চাউনি দিতো শন দিয়ে। বাপ দাদার পেশায় আঁকড়ে থাকা শনের চাউনির কারিগর ছিল প্রতিটি গ্রামে।
বিশ্বায়নের এই যুগে মানুষের আচার আচারণ, থাকা খাওয়ার সব ক্ষেত্রে আসে পরিবর্তন। এই পরিবর্তনের জোয়ারে ভেসে যায় শনের ব্যবহারও। ঘরে চাউনিতে শনের পরিবর্তে ব্যবহার বাড়ে টিন আন ইট পাথরের। শনের চাউনিতে পারদর্শিরা পেশা পরিবর্তন করে চলে যায় অন্য কর্মে। এভাবে হারিয়ে যায় শনের উৎপাদন ও ব্যবহার।
অনেকেই বলেছেন, কদাচিৎ কোনো মানুষ শনের ছাউনিতে আগ্রহী হয়ে উঠলেও তাকে শন সংগ্রহ করতে হয় অনেক কষ্টে দুর্গম পাহাড় টিলা থেকে। প্রবীণরা মনে করেন ঘরের চাউনিতে শনের বিকল্প নেই। রান্নাঘরের ধুঁয়ায় টিন অল্পদিনে নষ্ট হয়। অথচ শনের চাউনিতে ঘর গ্রীষ্মে ঠাণ্ডা ও শীতে গরম থাকে। ধোঁয়ায় ঘরের চালা নষ্ট হয় না।
অতি সম্প্রতি খাগড়াছড়ির রামগড়ে এক শ্রমজীবি প্রবীণ ব্যক্তিকে দেখা গেছে কাধে শনের ভার নিয়ে যেতে। সত্তুরোর্ধ বয়সী ফজল করিম বলেছেন, দুর্গম পাহাড় টিলা থেকে এসব শন তিনি সংগ্রহ করে নিয়ে আসছেন। তিনি জানান তার রান্না ঘরের চাউনি দেয়ার প্রয়োজনে অনেক কষ্টে পাহাড় টিলায় ঘুরে এসব শন সংগ্রহ করেছেন। ঘরে শনের পরিবর্তে টিন ব্যবহার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এই যুগের ছেলে মেয়েরা বুঝবে না শনের ঘরের উপকারিতা। টিনের ঘরের চাইতে শনের তৈরী ঘরের নিচে থাকা কতটুকু সস্তির যতক্ষণ ফরাক করে দেখবে না ততক্ষণ তারা উপলব্দি করতে পারবে না।
শনের গরগুলো গুলো দেখতে যেমন সুন্দর, তেমনি শীতল, আকর্ষণীয় ও আরামদায়ক। যদিও আধুনিকতার ছোঁয়ায় শনের তৈরি ঘরের প্রবণতা কমে গেছে। তবে পার্বত্যাঞ্চলের ক্ষুদ্র নৃ- গোষ্ঠী সম্প্রদায়ের লোকেরা পাহাড়ের ভাঁজে ভাঁজে শন দিয়ে ঘর তৈরি করে এখানে বসবাস করছে।
একসময় তিন পার্বত্য জেলা রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবানে ব্যাপক শণের কদর ছিল। কিন্তু কালের বিবর্তন ও জুম চাষের কারণে হুমকিতে পড়েছে পাহাড়ি শনের ঘর।
এক সময়ের শন চাষি জ্যোতির্ময় চাকমা জানান, শন চাষে কম শ্রমে বেশি লাভ থাকলেও এখন আর চাষে আগ্রহ দেখান না চাষিরা। কারণ পাহাড়ের মানুষ এখন আর বাঁশ ও শন দিয়ে ঘর তৈরি করতে চায় না। অনেক আরামদায়ক হলেও এ ঘরগুলো বেশিদিন টেকসই হয় না। বছর বছর মেরামত করতে হয়।
জানা গেছে, আশ্বিন ও চৈত্র পর্যন্ত শণ আহরণ করা হয়। শণ চাষের জন্য পাহাড়ের ছোট ছোট গাছপালা ও লতাপাতা পরিষ্কার করে দিলে কিছু দিন পর প্রাকৃতিকভাবেই শন জন্মায়।
উৎপাদিত শন গাছগুলো ৬-৭ ফুট লম্বা হওয়ার পর কাটার উপযুক্ত হয়। বাজারজাত করার জন্য আহরিত শণগুলো মাসখানেক রোদে শুকিয়ে নিতে হয়। ভালো করে রোদে শুকানোর পর তা ব্যবহারের উপযোগী হবে। তবে বাজারে আশ্বিন মাসের শনের চাহিদা থাকে না। বরং বর্ষা মৌসুমের শনের চাহিদা বেশি। তখন শনের বোঝা ১৪০ থেকে ১৬০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি করা যায়।
এ সম্প্রসারণের বিষয়ে অনেকেই জানান, টিনের চেয়ে শনের ঘর অনেক বেশি শীতল ও ঠাণ্ডা। হাজার বছর ধরে পাহাড়ি মানুষ গুলো শন দিয়ে ঘর তৈরি করে আসছে। কালের বিবর্তনে শনের ব্যবহার কমে যাওয়ায় তা অস্তিত্ব হারাতে বসেছে। তবে শনের নানাবিধ ব্যবহার বাড়ানো গেলে হয়তো পাহাড়িশন রক্ষা করা সম্ভব হবে।