করোনার নির্মম আঘাতে থেমে গেছে প্রতিবন্ধী মিজানের জীবন
বিশেষ প্রতিবেদক: জীবনের সাথে যুদ্ধ করে হুইল চেয়ারে বসে প্রাইভেট পড়িয়ে সংসার চালানো প্রতিবন্ধী মিজানুর রহমানের অর্থের চাকা বন্ধ হয়ে গেছে করোনা মহামারিতে।
দুই ছেলে-মেয়ে আর স্ত্রীকে নিয়ে চার সদস্যার সংসারে আয়-রোজকার করার কেউ নেই। তাই নিজেই হুইল চেয়ারে বসে পাড়ার বাচ্চাদের প্রাইভেট পড়িয়ে প্রাপ্ত অর্থ দিয়ে কোনোভাবে সংসার চালান তিনি।
মিজানুর রহমান জেলার মাটিরাঙ্গা উপজেলার তবলছড়ি ইউপির ধনমিয়া সর্দার পাড়া মোঃ সিরাজুল ইসলামের বড় ছেলে।
এসএসসি পাশ করার পর ২০০৪ সালে ফেনী নানার বাড়িতে বেড়াতে গিয়ে আম গাছে উঠে আম পাড়তে। আম পাড়ার আগেই তিনি গাছ থেকে নিছে পরেন। তার মেরুদন্ড ভেঙ্গে যায়। ২৫ মাস চিকিৎসার পরও তিনি সচল হয়নি। দুইটি পা সারা জীবনের জন্য অবস হয়ে গেছে।
গাছ থেকে পরে মেরুদন্ড ভাঙ্গার পর তিনি ফেনী হাসপাতালে দুইদিন, ঢাকা পঙ্গু হাসপাতালে ১ মাস, কুমিল্লা এক কবিরাজের বাড়িতে ১৭ মাস, চট্টগ্রাম মেডিক্যালে ১ মাস,সিআরপি হাসপাতালে ৫ মাস চিকিৎসা নিয়েও সচল হতে পারেনি।
অসুস্থ হয়ে কবিরাজের বাড়িতে দীর্ঘদিন চিকিৎসাদিন থাকার সময় ওখানকার কিছু ছেলে-মেয়েদের প্রাইভেট পড়াতেন তিনি। সেখান থেকে সাবিনা আক্তার নামে একজনের সাথে শুরু হয় প্রেমের সম্পর্ক। দীর্ঘ ৭ বছর প্রেম করার পর ২০১১ সালে ভালোবাসার টানে মিজানুর রহমানে উদ্দেশ্য বাবার বাড়ি ছেড়ে কুমিল্লা থেকে খাগড়াছড়ি চলে আসেন সাবিনা। মিজান কোর্টে বিয়ে করে নিয়ে যায় তার বাড়িতে। শুরু হয় দুজনের সুখের সংসার। বর্তমানে তাদের এক ছেলে ও এক মেয়ে সন্তান রয়েছে।
এদিকে বাবার বাড়ি ছেড়ে চলে আসার পর ৭ বছর সাবিনার নিকট আত্মীয় কেউ তার খোঁজ খবর নেয়নি। বিয়ে হওয়ার ৭ বছর পর তার মামা এসে খোঁজ নেয় তাদের। এরমধ্যে তাদের ঘরে জন্ম নিয়েছে দুই সন্তান। মিজানুর রহমানকে স্ত্রী বাচ্চাসহ শশুর বাড়িয়ে দাওয়াত করে নিয়ে যায়। এখন উভয়ের মধ্যে খুবই সুন্দর সম্পর্ক সৃষ্টি হয়েছে।
প্রতিবন্ধি মিজানুর রহমান ও সাবিনা আক্তারের এক ছেলে মোঃ হাসান(৯) ও এক মেয়ে মারজানা আক্তার(৬)।
দুর্ঘটনায় মেরুদন্ড ভেঙ্গে অস্বচ্ছল হওয়ার পর থেকে প্রাইভেট পড়িয়ে তার জীবন চলা শুরু হয়। এখনো এই পেশার মধ্যেই রয়েছেন তিনি। কিন্তু সর্বশেষ করোনার আঘাতে সারাদেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাওয়ার পরে প্রাইভেট বন্ধ হয়ে যায়। দীর্ঘ এক বছর বন্ধ থাকার কারণে মিজানের জীবনের গতিও যেনো বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।
একটি স্কুলে খন্ডকালীন হিসেবে চাকরি করতেন কিছুদিন আগে থেকে। সাথে কিছু প্রাইভেট পড়াতো এটা দিয়ে তার সংসার কোনোভাবে চলতো। কিন্তু করোনার আঘাতে সব শেষ হয়ে গেলো।
এখন শুধু একমাত্র চলার গতি ২০০৯ সাল থেকে পাওয়া প্রতিবন্ধী ভাতার কার্ডের অর্থ। কিন্তু চার সদস্যের পরিবারে এই অর্থ দিয়ে চলার কোনো উপায় নেই।
মিজানুর রহমানের চলার পথের সঙ্গী তার একমাত্র ছেলো মোঃ হাসান। কোনোদিকে যাওয়ার সময় বাবার হুইল চেয়ারের পেছন থেকে ঠেলতে থাকে ছেলে। বাবা-ছেলের সমন্বয়ে চলে তার হুইল চেয়ারের চাকা। যেতে পারে গন্তব্যে।
স্থানীয়রা জানান, অনেক বছর ধরে তিনি প্রতিবন্ধী হয়ে পড়ে আছেন। এলাকার ছেলে-মেয়েদের প্রাইভেট পড়িয়ে কোনো রকম সংসার চালায়। তার দুই সন্তার আর বউ নিয়ে চলা খুবই কস্টকর। তার আয় -রোজকারের কোনো ব্যবস্তা করা গেলে সে ভালোভাবে ছেলে-মেয়ে নিয়ে বেঁচে থাকতে পারবে।
মিজানুর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমি গাছ থেকে পড়ে মেরুদন্ড ভাঙ্গার পর অনেক জায়গায় চিকিৎসা নিয়েছি কিন্তু সচল হতে পারিনী। তারপরও জীবন যুদ্ধে থেমে থাকিনী। এলাকায় প্রাইভেট পড়িয়ে সংসার চালাই। করোনার কারনে এখন সবকিছুই বন্ধ। এই মহামারিতে আমার সংসার চালাতে খুব কস্ট হচ্ছে। জীবন চালানোর জন্য সরকারীভাবে আয়-রোজকারের কোনো ব্যবস্থা করে দিলে আমি ভালোবাবে চলতে পারতাম।
সাবিনা আক্তার বলেন, পঙ্গু অবস্থায় দেখে ভালোবেসে তাকে বিয়ে করেছি। এখন আমাদের দুইটি বাচ্চা। হুইল চেয়ারে বসেই সে প্রাইভেট পড়িয়ে প্রাপ্ত অর্থ দিয়ে আমাদের সংসার চালায়। এই একবছরে করোনার আঘাতে তার কোনো আয়-রোজকার নাই। আমাদের চলতে খুব কস্ট হচ্ছে। সরকারিভাবে যদি কোনো কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে দেয় তাহলে ভবিষ্যতে ভালোভাবে চলতে পারবো।
জেলা প্রতিবন্ধী বিষয়ক কর্মকর্তা মোহাম্মদ শাহজাহান বলেন, বর্তমান সরকার প্রতিবন্ধীদের জন্য বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা রেখেছে। প্রতিবন্ধী মিজানুর রহমান হুইল চেয়ার ছাড়া চলতে পারেনা। সে আমাদের দেওয়া প্রতিবন্ধী ভাতার কার্ডের অন্তর্ভুক্ত আছে। এছাড়াও তার কোনো কাজের জন্য যদি আমাদের কাছে নির্দিষ্টভাবে আবেদন করে তাহলে তাকে আমাদের দপ্তর থেকে যতটুকু সম্ভব আমরা তাকে দেওয়ার চেষ্টা করবো।