খাগড়াছড়িতে অস্থিরতার পেছনে ভারতের ইন্ধন থাকার অভিযোগ

শেয়ার করুন

খাগড়াছড়ি প্রতিনিধি: পার্বত্য খাগড়াছড়ি জেলা গত কয়েকদিন ধরে রক্তাক্ত সহিংসতায় কেঁপে উঠেছে। ২৩ সেপ্টেম্বর খাগড়াছড়ি সদর উপজেলার সিঙ্গিনালা এলাকায় এক স্কুলছাত্রীকে দলবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনায় যে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়েছিল, তা থেকেই এই অস্থিরতার সূত্রপাত। এই ঘটনার জের ধরে টানা বিক্ষোভ, সড়ক অবরোধ, সংঘর্ষ, হামলা ও অগ্নিসংযোগে খাগড়াছড়ি ও আশপাশের জনপদ অস্থির হয়ে ওঠে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে শনিবার থেকে ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছে। সেনা, পুলিশ ও বিজিবি মোতায়েন করা হলেও সাধারণ মানুষের মধ্যে এখনও তীব্র আতঙ্ক বিরাজ করছে।

২৩ সেপ্টেম্বর অষ্টম শ্রেণির ওই শিক্ষার্থী দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়। এই ঘটনায় পুলিশ শয়ন শীল (১৯) নামে একজনকে গ্রেপ্তার করে রিমান্ডে নিয়েছে, তবে অন্যান্য আসামিরা এখনও পলাতক।

এই ঘটনার প্রতিবাদে শিক্ষার্থী ও স্থানীয়রা “জুম্ম ছাত্র-জনতা”র ব্যানারে বিক্ষোভে নামে। ২৪ সেপ্টেম্বর হাজারো মানুষ মিছিল করে চেঙ্গী স্কোয়ারে সমাবেশ করে এবং সেখান থেকে সড়ক অবরোধের ঘোষণা দেওয়া হয়।
সহিংসতা ও ১৪৪ ধারা জারি

২৭ সেপ্টেম্বর সকাল থেকে চলা অবরোধ দুপুরের পর সহিংস রূপ নেয়। খাগড়াছড়ি উপজেলা এলাকার মসজিদে একদল সন্ত্রাসী হামলা চালায়। দরজা-জানালা ভাঙচুরের পাশাপাশি আশপাশের দোকানে অগ্নিসংযোগ ও পথচারীদের নির্বিচারে মারধর করা হয়। আতঙ্কে নারী-শিশুসহ সাধারণ মানুষ পালাতে থাকে। শহরের মহাজন পাড়ায় পাহাড়ি–বাঙালি সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ে। স্থানীয়দের অভিযোগ, হামলাকারীরা শুধু সম্পদ ধ্বংস করেনি, বরং গুলি ছুড়ে এলাকায় তীব্র আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে।

সহিংসতার পর খাগড়াছড়ি জেলা প্রশাসন শনিবার (২৭ সেপ্টেম্বর) দুপুর ২টা থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য ১৪৪ ধারা জারি করে। জেলা প্রশাসক এবিএম ইফতেখারুল ইসলাম খন্দকার জানান, পরিস্থিতি উন্নত না হওয়া পর্যন্ত এই ধারা বহাল থাকবে এবং অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। জেলা পুলিশ সুপার মো. আরেফিন জুয়েল জানান, হামলা ও ভাঙচুরের ঘটনায় মামলা করার প্রস্তুতি চলছে।

২৯ সেপ্টেম্বর (সোমবার) রাজধানীতে এক অনুষ্ঠানে রাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী অভিযোগ করেন— ভারত ও ফ্যাসিস্টদের ইন্ধনে খাগড়াছড়িতে অস্থিরতা তৈরি করা হচ্ছে।

তিনি বলেন, “একটি মহল চায় দুর্গাপূজা শান্তিপূর্ণভাবে না হোক। তারা পার্বত্য চট্টগ্রামে অস্থিরতা ছড়াচ্ছে। সরকার সর্বোচ্চ ব্যবস্থা নিচ্ছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক উপদেষ্টা স্থানীয় নেতাদের সঙ্গে সমন্বয় করছেন।”

সেনাবাহিনী এক বিবৃতিতে জানায়, খাগড়াছড়ি ও গুইমারায় সহিংসতা ছড়াতে ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ) এবং এর সহযোগী সংগঠনগুলো সক্রিয়।

সেনাবাহিনীর অভিযোগে বলা হয়-ইউপিডিএফ নারী ও শিক্ষার্থীদের নাশকতায় ব্যবহার করছে। বহিরাগত সন্ত্রাসীদের পাহাড়ে ঢুকিয়ে দাঙ্গা উসকে দিচ্ছে।
সেনা টহল দলের ওপর হামলা, অ্যাম্বুলেন্সে আক্রমণ, রাস্তা অবরোধ ও গুলি চালাচ্ছে।

২৬-২৮ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত খাগড়াছড়ি–গুইমারায় এসব সহিংসতায় সেনা ও বিজিবির অন্তত ২০ সদস্য আহত হয়েছেন। গুইমারায় সশস্ত্র হামলায় তিনজন নিহত ও মেজরসহ ১৩ সেনাসদস্য আহত হন। এক পর্যায়ে বহিরাগত দুষ্কৃতিকারীরা রামসু বাজারে অগ্নিসংযোগ করলে উত্তেজনা বাড়ে। অতিরিক্ত সেনা মোতায়েনের পর পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসে।

সোমবার সকালে নিরাপত্তা বাহিনীর পাহারায় সাজেকে আটকে থাকা প্রায় ৫০০ পর্যটক খাগড়াছড়ির উদ্দেশে রওনা হন। বর্তমানে দূরপাল্লার বাসও সেনা পাহারায় চলছে।

সোমবার থেকে শুরু হওয়া শারদীয় দুর্গোৎসব ঘিরে হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে উদ্বেগ বাড়ছে। স্থানীয়রা বলছেন, সহিংসতায় ধর্মীয় সম্প্রীতি নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। অনেকেই শান্তি ফিরিয়ে আনার জন্য সেনা ও প্রশাসনের কঠোর পদক্ষেপ দাবি করছেন।

খাগড়াছড়ি বিজিবি’র সেক্টর কমান্ডার কর্নেল মোঃ আব্দুল মোত্তাকিম (২৯ সেপ্টেম্বর) সোমবার এক প্রেস ব্রিফিংয়ে জানান, ২৭ সেপ্টেম্বর খাগড়াছড়ি শহর ও স্বনির্ভর বাজার এলাকায় সংঘর্ষ ও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে। ঘটনার দিনই সাত প্লাটুন বিজিবি মোতায়েন করা হয় এবং তারা শান্তিপূর্ণভাবে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। বর্তমানে নয়টি প্লাটুন শহর ও স্বনির্ভর বাজার এলাকায় দিন-রাত টহল দিচ্ছে। তিনি আশ্বস্ত করেন, পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত বিজিবি জনগণের পাশে থেকে দায়িত্ব পালন করবে। তিনি স্থানীয় জনগণ ও সাংবাদিকদের ধৈর্য ও সহনশীলতার পরিচয় দেওয়ার আহ্বান জানান।

সেনাবাহিনী জানিয়েছে, সব ধরনের উসকানি ও অপপ্রচারের বিরুদ্ধে তারা পাহাড়ের সব জাতিগোষ্ঠীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। তারা স্থানীয় জনগণ ও রাজনৈতিক নেতাদের সংযম দেখাতে এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সহযোগিতা করার আহ্বান জানিয়েছে।

ধর্ষণ মামলার সূত্র ধরে শুরু হওয়া এই আন্দোলন এখন সহিংস রূপ নিয়েছে। প্রশাসন বলছে, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সর্বোচ্চ ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। তবে সাধারণ মানুষ দ্রুত শান্তি ফিরে আসার প্রত্যাশায় দিন কাটাচ্ছে আতঙ্কে।