অনেকের শিরশ্ছেদ, রোহিঙ্গা মুসলিমদের ওপর আরাকান আর্মির বর্বরতা

শেয়ার করুন

পাহাড়ের আলো: মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সামরিক জান্তার সঙ্গে তুমুল লড়াই চালিয়ে যাওয়া আরকান আর্মির বিরুদ্ধে রোহিঙ্গাদের অপহরণ, নির্যাতন, হত্যা, শিরশ্ছেদসহ যুদ্ধাপরাধ সংঘটনের অভিযোগ তুলেছে দেশটির মানবাধিকার সংস্থা ফোর্টিফাই রাইটস। একই সঙ্গে এসব অপরাধ তদন্তে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের (আইসিসি) প্রতি আহ্বান জানিয়েছে সংস্থাটি।

সম্প্রতি সংস্থাটির ওয়েবসাইটে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এ আহ্বান জানিয়ে বলা হয়, ফোর্টিফাই রাইটসের নতুন এক তদন্তে উঠে এসেছে যে, রাখাইনের বেশির ভাগ অংশ নিয়ন্ত্রণকারী আরকান আর্মির তাদের নিয়ন্ত্রণাধীন অস্থায়ী আটক কেন্দ্র এবং গ্রামগুলোতে যুদ্ধ আইনের গুরুতর লঙ্ঘন ঘটিয়েছে। সূত্র: পার্বত্য নিউজ।

প্রতিবেদনে ফোর্টিফাই রাইটসের মানবাধিকার বিশেষজ্ঞ এজাজ মিন খান্ত বলেন, ‘আরকান আর্মির রোহিঙ্গাদের ব্যাপক হারে অপহরণ, নৃশংস নির্যাতন এবং হত্যার জন্য দায়ী। নির্যাতিত রোহিঙ্গাদের অনেকের শিরশ্ছেদ করা হয়েছে, যা যুদ্ধ আইনের ভয়ানক লঙ্ঘন। আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের এখতিয়ার রয়েছে এবং তাদের উচিত রাখাইন রাজ্যে গুরুতর অপরাধের তদন্ত ও বিচার করা, যেসব ঘটনায় অপরাধীদের মধ্যে আরকান আর্মির সদস্যরাও অন্তর্ভুক্ত।’

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২৫ সালের এপ্রিল থেকে জুলাই পর্যন্ত ফোর্টিফাই রাইটস ৩৯ জন রোহিঙ্গার (আটজন নারীসহ) সাক্ষাৎকার নিয়েছে, যারা ২০২৪ ও ২০২৫ সালে আরকান আর্মির  হাতে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন বা প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন।

ফোর্টিফাই রাইটস আরকান আর্মির অপরাধের স্থির এবং ভিডিও চিত্র প্রমাণ হিসেবে পর্যালোচনা ও বিশ্লেষণ করেছে। এ ছাড়া ফোর্টিফাই রাইটস আরকান আর্মির নিয়ন্ত্রিত গ্রাম এবং অস্থায়ী আটক কেন্দ্রগুলোতে একাধিক বেসামরিক রোহিঙ্গা নাগরিকের হত্যাকাণ্ডের ঘটনা নথিভুক্ত করেছে, যার মধ্যেআরকান আর্মির হাতে পাঁচজনের শিরশ্ছেদের ঘটনাও রয়েছে।

এই অনুসন্ধানে একটি পদ্ধতিগত প্যাটার্নও উন্মোচিত হয়েছে, যেখানে রোহিঙ্গাদের অপহরণের পরআরকান আর্মি নিয়ন্ত্রিত আটককেন্দ্র ও শহরগুলোতে নিয়ে নির্যাতন বা হত্যার প্রমাণ মিলেছে। বেঁচে ফেরা ব্যক্তিরা জানিয়েছেন, রোহিঙ্গা সশস্ত্র গোষ্ঠীর সঙ্গে সম্পর্ক থাকার ভিত্তিহীন অভিযোগ তুলে অথবা আরাকান আর্মিতে যোগ দিতে অস্বীকৃতি জানানোর কারণে তাদের আটক করে নিয়ে নির্যাতন চালানো হয়।

ফোর্টিফাই রাইটসের প্রতিবেদনে আরকান আর্মির হাতে আটকের পর বেঁচে ফেরা এবং বিভিন্ন ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ও স্বজন হারানো বেশ কয়েকজনের জবানিতে নির্যাতন ও হত্যার ঘটনা তুলে ধরা হয়েছে। আহমেদ নামে ২১ বছর বয়সী এক রোহিঙ্গা ফোর্টিফাই রাইটসকে জানান কীভাবে ২০২৫ সালের মার্চের রমজান মাসে ইউনিফর্ম পরা আরকান আর্মির যোদ্ধারা তার ভাইকে তুলে নিয়ে শিরশ্ছেদ করেছিল। এ ছাড়া এক প্রত্যক্ষদর্শী ২০২৪ সালের এপ্রিলে থা ইয়েত ওক গ্রামের আবুজা হ্যামলেট থেকে পাঁচজন রোহিঙ্গা পুরুষকে আরকান আর্মি তুলে নিয়ে যাওয়ার ঘটনা বর্ণনা করেন।

তিনি জানান, পরবর্তী সময়ে ওই পাঁচজনের মৃতদেহ পা ওয়া যায়, যাদের চারজনেরই শিরশ্ছেদ করা হয়েছিল এবং সবকটি দেহে নির্যাতনের চিহ্ন ছিল। ফোর্টিফাই রাইটসের কাছে থাকা ১৮ সেকেন্ডের মোবাইল ফোন ভিডিওতেও একটি ছোট পুকুরে ওই পাঁচজনের মৃতদেহ পড়ে থাকতে দেখা যায়, যার মধ্যে চারজনের শিরশ্ছেদ করা হয়েছিল।

আরকান আর্মির নির্যাতনে ভাই হারানো রাখাইন রাজ্যের বুথিডাং টাউনশিপের ফতেহ আলী ফারা ফোর্টিফাই রাইটসকে জানান, তার ভাইকে আরকান আর্মির লোকজন কীভাবে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে মেরে ফেলেছিল। তিনি জানান, তুলে নেওয়ার দুই মাস পর আরকান আর্মির সদস্যরা এসে জানায়, বোরিয়াং গ্রামে ভাইয়ের মৃতদেহ পড়ে আছে। পরে সেখানে গিয়ে তিনি তার ভাইয়েরসহ ১২ জনের মৃতদেহ পড়ে থাকতে দেখার কথা জানান।

আরকান আর্মির হাতে আটক হওয়ার পর বেঁচে ফেরা আবদুল্লাহ নামে ২১ বছর বয়সী এক যুবক তার ওপর হওয়া নির্যাতনের বর্ণনা দেন ফোর্টিফাই রাইটসকে। তিনি জানান, আটক অবস্থায় আরকান আর্মিরসদস্যরা তাকে বাঁশ ও তার দিয়ে বেধড়ক পেটাত এবং যত জোরে পারত তাকে লাথি ও ঘুষি মারত। যন্ত্রণায় চিৎকার করলে তারা মুখে কাপড় গুঁজে দিত। আবদুল্লাহর মতো বেঁচে ফেরা আরও কয়েকজনের অভিজ্ঞতাও তুলে ধরা হয়েছে ফোর্টফাই রাইটসের প্রতিবেদনে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, গত ১৪ জুলাই ফোর্টিফাই রাইটসের পক্ষ থেকে অভিযোগগুলো নিয়ে আলোচনা করার জন্য আরাকান আর্মিকে চিঠি পাঠায়। জবাবে আরকান আর্মি উল্লেখিত ঘটনাগুলোর বিষয়ে আরও বিস্তারিত তথ্য চায়। পরে ১৮ জুলাই ফোর্টিফাই রাইটস আরকান আর্মি দ্বারা রোহিঙ্গা বেসামরিক নাগরিকদের হত্যা এবং নির্যাতনের সাক্ষ্য ও বিবরণ সংবলিত তিন পৃষ্ঠার একটি নথি সরবরাহ করে এবং আবারও প্রতিক্রিয়া জানতে চায়।

এরপর ২০ জুলাই আরকান আর্মি লিখিতভাবে জবাব দেয়, যেখানে গোষ্ঠীটি তাদের বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগগুলোকে ‘মিথ্যা ও মানহানিকর’ আখ্যায়িত করে এগুলো প্রত্যাখ্যান করে। তাদের বিবৃতিতে এ বিষয়ে বলা হয়, ‘আপনার অভিযোগগুলো পরীক্ষা করার পর এটি একেবারেই সুস্পষ্টভাবে প্রতীয়মান যে, এসব অভিযোগ আমাদের সুনাম নষ্ট করার লক্ষ্যে ইচ্ছাকৃত, পুনরাবৃত্তিমূলক এবং বিদ্বেষপূর্ণ আক্রমণ। এই বানোয়াট বর্ণনাগুলো কয়েকটি বর্ণবাদী এবং ইসলামিক চরমপন্থি ব্যক্তির রাজনৈতিক লাভের জন্য রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নিয়ে তৈরি করা হয়েছে।’

ফোর্টিফাই রাইটসের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এমন প্রেক্ষাপটে আইসিসির প্রধান প্রসিকিউটরের উচিত রোহিঙ্গা বেসামরিক নাগরিকদের ওপর আরকান আর্মির হামলাগুলোকে তার চলমান তদন্তের অংশ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা। কারণ হিসেবে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শিরশ্ছেদসহ অঙ্গহানি জেনেভা কনভেনশনের ৩ নম্বর অনুচ্ছেদের পাশাপাশি আইসিসির রোম সংবিধির ৮ নম্বর অনুচ্ছেদেও যুদ্ধাপরাধ হিসেবে বিবেচিত।

এতে আরও বলা হয়েছে, ফোর্টিফাই রাইটস ধারাবাহিকভাবে আরকান আর্মির নিয়ন্ত্রণাধীন এলাকায় জাতিগত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সংঘটিত যুদ্ধাপরাধের ঘটনা নথিভুক্ত ও প্রকাশ করেছে, যার মধ্যে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট মংডুর নাফ নদের কাছে রোহিঙ্গা বেসামরিক নাগরিকদের গণহত্যা এবং ২০২৪ সালের মে মাসে রোহিঙ্গা বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগের ঘটনাও রয়েছে।

আরকান আর্মি এই অভিযোগগুলো অস্বীকার করেছে এবং এ অপরাধগুলোর জন্য এখনো দায়িত্ব স্বীকার করেনি বা তাদের সৈন্যদের জবাবদিহির আওতায় আনেনি। এ ছাড়া ২০২৫ সালের জানুয়ারিতে আরকান আর্মি প্রকাশ্যে স্বীকার করে যে তাদের সৈন্যরা দুই যুদ্ধবন্দিকে নির্যাতন এবং সংক্ষিপ্ত বিচার করে হত্যা করেছে, যা আন্তর্জাতিক মানবিক আইনের অধীনে একটি যুদ্ধাপরাধ।

এ প্রসঙ্গে এজাজ মিন খান্ত বলেন, ‘আরাকান আর্মিকে আটক কেন্দ্র এবং গ্রামগুলোতে রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতন, দমনপীড়ন ও হত্যা অভিযান বন্ধ করতে হবে। আরকান আর্মি যদি একটি বৈধ বিপ্লবী সশস্ত্র বাহিনী হিসেবে পরিচিত হতে চায়, তবে তাদের অবশ্যই আন্তর্জাতিক আইনকে সম্মান করতে হবে, বেসামরিক নাগরিকদের সুরক্ষা দিতে হবে এবং তারা যে নৃশংসতা করেছে তার জন্য জবাবদিহি করতে হবে।’