খাগড়াছড়িতে আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন প্রতিরোধ পক্ষ উপলক্ষে মানববন্ধন ও আলোচনা সভা
দহেন বিকাশ ত্রিপুরা, খাগড়াছড়ি: খাগড়াছড়িতে আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন প্রতিরোধ পক্ষ উপলক্ষে WHRDs দিবস উদযাপন কমিটির উদ্যোগে মানববন্ধন ও আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। রবিবার (২৯নভেম্বর ২০২০খ্রিঃ) সকালে ৯টায় ‘নারীর জন্য বিশ্ব গড়ো, পর্যাপ্ত বিনিয়োগ করো, সহিংসতা প্রতিরোধ করো’ এই প্রতিপাদ্যে জেলা শহরের শহীদ মিনার প্রাঙ্গনে আধা ঘন্টা ব্যাপী মানববন্ধন শেষে অফিসারস্ ক্লাবে আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে খাগড়াপুর মহিলা কল্যাণ সমিতির নির্বাহী পরিচালক ও WHRDs দিবস উদযাপন কমিটির আহবায়ক শেফালিকা ত্রিপুরার সভাপতিত্বে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদের সদস্য শতরূপা চাকমা।
এদিকে মানববন্ধনে খাগড়াপুর মহিলা কল্যাণ সমিতির গীতিকা ত্রিপুরার সঞ্চালনায় সংহতি জানিয়ে বক্তব্য দেন এ্যাডভোকেট অনুপম চাকমা। অন্যদিকে আলোচনা সভায় WHRDs দিবস উদযাপন কমিটির সদস্য সচিব কীর্তিকা চাকমার সঞ্চালনায় অন্যান্যের মাঝে বক্তব্য রাখেন জাবারাং কল্যাণ সমিতির নির্বাহী পরিচালক মথুরা বিকাশ ত্রিপুরা, তৃণমূল উন্নয়ন সংস্থার নির্বাহী পরিচালক রিপন চাকমা, খাগড়াছড়ি প্রেসক্লাবের সভাপতি জীতেন বড়ুয়া, খাগড়াছড়ি পুলিশের সদর থানার প্রতিনিধি এসআই বিকিরণ চাকমা, দুর্বার নেটওয়ার্কের প্রতিনিধি নমিতা চাকমা, WHRDs দিবস উদযাপন কমিটির সদস্য দয়ানন্দ ত্রিপুরা, কাবিদাং’র নির্বাহী পরিচালক লালসা চাকমা, খাগড়াপুর মহিলা কল্যাণ সমিতির কার্যনির্বাহী সদস্য শাপলা দেবী ত্রিপুরা প্রমুখ। এসময় আরও উপস্থিত বাংলাদেশ নারী প্রগতি সংঘ’র প্রতিনিধি নবলেশ্বর দেওয়ান ত্রিপুরা, উইমেন রিসোর্স নেটওয়ার্কের খাগড়াছড়ি জেলা সমন্বয়ক ও সাংবাদিক চিংমেপ্রু মারমাসহ বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা, সামাজিক সংগঠনের প্রতিনিধি, যুব সংগঠন, ছাত্র ও অভিভাবকবৃন্দ।
এসময় এসডিজির প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী বিশ্বব্যাপী নারীদের জীবনমান উন্নয়ন এবং নির্যাতন ও ক্ষতিকর চর্চা থেকে তাদের মুক্ত করতে সব ধরনের বৈষম্য ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে জরুরি পদক্ষেপ গ্রহণ করা দরকার বলে নারী নির্যাতন প্রতিরোধ পক্ষে কয়েকটি করণীয়সমূহ বাস্তবায়নে উত্থাপন করেন: ১। নারীর ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে পর্যাপ্ত বিনিয়োগ করতে হবে। ২। জাতি ধর্ম, বণৃ নির্বিশেষে সম্পদ ও সম্পত্তিতে নারীর সমঅধিকার নিশ্চিত করতে হবে। ৩। বাল্যবিবাহ বন্ধ করতে হবে, মেয়ে শিশুর স্বাভাবিক বিকাশ নিশ্চিত করতে হবে। ৪। নারীর প্রতি সকল প্রকার বৈষম্যমূলক আইনের পরিবর্তন করতে হবে। ৫। আইনের সঠিক, নিরপেক্ষ ও সময়ানুগ প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। ৬। মহামান্য হাইকোর্টের নির্দেশনা অনুযায়ী ঘটনাস্থলকে মূখ্য বিবেচনা না করে ধর্ষণ, যৌন নিপীড়ন বা এ ধরনের আমলযোগ্য অপরাধের ঘটনায় কোনো বৈষম্য, বিলম্ব ছাড়াই তাৎক্ষণিকভাবে থানায় অভিযোগ লিপিবদ্ধ করতে হবে। ৭। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের আওতায় ব্যক্তিগত গোপনীয়তা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। ৮। যৌতুক আদান-প্রদানকারীকে এবং বাল্যবিবাহের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে সামাজিকভাবে বয়কট করতে হবে এবং তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে হবে। ৯। আইনের সঠিক, নিরপেক্ষ ও সময়ানুসারে প্রয়োগ নিশ্চিতকরণে সরকারের দায়বদ্ধতা তৈরি করতে হবে। ১০। বিচার বিভাগসংশ্লিষ্ট সকল পর্যায়ের সেবাদানকারী সদস্যদের জেন্ডার সংবেদশীল করে গড়ে তুলতে হবে এবং জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে। ১১। নারী নির্যাতনকারীকে রাজনৈতিক, সামাজিক ও প্রশাসনিক আশ্রয়-প্রশয় দেয়া বন্ধ করতে হবে। ১২। প্রতিটি থানায় ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টার চালু করতে হবে, যা নারী পুলিশ দ্বারা পরিচালিত হবে। ১৩। যৌন সহিংসতা বন্ধে যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য শিক্ষার সহায়ক পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। ১৪। ধর্ষণের শিকার নারীর প্রতি সংবেদনশীল হয়ে পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্রকে তার পাশে দাঁড়াতে হবে এবং তার মানসিক শক্তি বৃদ্ধি, চিকিৎসাসহ ন্যায়বিচার প্রাপ্তিতে সহায়তা করতে হবে। ১৫। সর্বজনীন পারিবারিক আইন চালু করতে হবে। ১৬। উত্তরাধিকারে নারীর সমঅধিকার নিশ্চিত করতে হবে। ১৭। নারীর বিরুদ্ধে নির্যাতন ও বৈষম্য সৃষ্টি করছে এমন সকল দৃষ্টিভঙ্গি, বিশ্বাস, আচরণ পরিবর্তনে জাতীয পর্যায় থেকে তৃণমূল পর্যন্ত জনসচেতনতা ও জনআন্দোলন সৃষ্টি ও পুরুষদের সম্পৃক্ত করতে হবে।
২৫ নভেম্বর থেকে ১০ ডিসেম্বর পর্যন্ত ১৬ দিনব্যাপী খাগড়াছড়িতে WHRDs দিবস উদযাপন কমিটি মানববন্ধন, আলোচনা সভাসহ নারীদের সক্ষমতা বিকাশের জন্য নানামুখী কার্যক্রম পরিচালনা করবে। উল্লেখ্য, নারী নির্যাতন প্রতিরোধে ব্যাপক জনসচেতনতা তৈরির উদ্দেশ্যে ১৯৯৯সালে জাতিসংঘ ২৫নভেম্বরকে আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন প্রতিরোধ দিবস (International Day for the Elimination of Violence against Women) হিসেবে ঘোষণা করে। ১৯৬০ সালের এই দিনটিতে ডমিনিকান রিপাবলিকে র্যাফাযের তুরজিলোর স্বৈরশাসনের (১৯৩০-১৯৬১) বিরুদ্ধে আন্দোলনকারী তিন বোনকে একই সাথে হত্যা করা হয়। অবশ্য এর অল্প কিছুদিনের মধ্যেই তুরজিলোর স্বৈরশাসনের অবসান ঘটে। এই তিন বোনের স্মরণে ও নারীর প্রতি সকর প্রকার সহিংসতা প্রতিরোধে ল্যাটিন আমেরিকাসহ বিশ্বের আরো কিছু দেশের নারী সংগঠনসমূহ এই দিনটিকে আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন প্রতিরোধ দিবস হিসাবে স্বীকৃতি দানের জন্য তখন থেকেই দাবি জানিয়ে এসেছে। ১৯৮১সালে ২৫নভেম্বর ল্যাটিন আমেরিকার নারীদের সম্মেলনে জাতিসংঘ এই দিনটিকে আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন প্রতিরোধ দিবস (International Day for the Elimination of Violence against Women) হিসেবে ঘোষণা করে।
১৯৯৩সালে অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনায় অনুষ্ঠিত বিশ্ব মানবাধিকার সম্মেলনে এই দিবসটি স্বীকৃতি পায়। তখন থেকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে দিবসটি যথাযথ মর্যাদা সহকারে পালন করা হচ্ছে এবং ১৯৯৭সাল থেকেই বাংলাদেশে প্রতি বছর দিবসটি পালন করে আসছে।