মাহে রমজানের সওগাত-২৫
মুহম্মদ আলতাফ হোসেন
পবিত্র মাহে রমজানের আজ ২৫তম দিবস। দান-সদকা ও দয়ার মাস মাহে রমজান বিদায় নিচ্ছে আমাদের মাঝ থেকে। এই মাসের দয়া ও করুণার ফলগু ধারায় আমরা কতটা সিক্ত হতে পারলাম। এখন সেই হিসাব নিকাশের পালা। মহনবী (সা) এর বাণী ও আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের ঘোষণায় রমজান দয়া ও করুণার মাস। এই মাসে উপবাসরত মুসলমানরা অভাবী লোকদের দুঃখ সরাসরি অনুভব করতে পারেন। রোজাদার হবে সর্বাধিক দয়ালু। ক্ষুধা, পিপাসা ও কষ্টের দাবী হচ্ছে, অন্য মুসলিম ভাইয়ের অভাব দূর করা। দেশের অগণিত মানুষ ক্ষুধা ও জঠরজ্বালার শিকার, তাদের প্রতি নজর দেয়া সহস্র লোক কাপড়হীন, তাদেরকে বস্ত্র দেওয়া হচ্ছে এ মাসের দান। হাদীসে এই মাসকে রহমত, ক্ষমা ও মুক্তির মাস বলা হয়েছে। স্বয়ং আল্লাহই মানুষকে রহম করেন এই মাসে। তাই রোযাদারকেও অন্যের প্রতি দয়া ও রহমতের শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে। দয়া ও রহমত হচ্ছে আল্লাহর একটি বিশেষ অনুগ্রহ। তিনি যাকে ইচ্ছে তার অন্তরে এই রহমত দান করেন। রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন, আল্লাহ দয়ালু লোকের উপর রহমত নাযিল করেন। আল্লাহ নিজেও দয়ালু এবং মেহেরবান। তিনি বান্দাদেরকে দয়া প্রদর্শনের আহ্বান জানিয়ে বলেন, তারাও যেন ধৈর্য এবং দয়ার উপদেশ দান করে।
মানুষের অন্তরে দয়া না থাকার অনেক কারণ আছে। অতিরিক্ত গুনাহ ও নাফরমানীর কারণে অন্তরে মরিচা পড়ে। ফলে, তা কঠোর বা পাষাণ হৃদয়ে পরিণত হয়। আল্লাহ ইহুদীদের পাপের কথা উল্লেখ করে বলেছেন, ‘তাদের অন্তর হয়ে গেছে পাথরের মতো, কিংবা এর চাইতেও বেশী (সূরা বাকারা-৭৪)।
আল্লাহ আরো বলেছেন, প্রতিশ্র“তি ভঙ্গ করার কারণে আমরা তাদের উপর অভিশাপ নাযিল করি এবং তাদের অন্তরকে শক্ত করে দেই (সূরা মায়েদা-১৩)।
অতিরিক্ত ভোগবিলাসের কারণেও অন্তর শক্ত হয়ে যায়। সেই জন্যই রমজানের আগমন, যেন মানুষের ক্ষুন্নিবৃত্তি ও ভোগবিলাসের উপর লাগাম দিতে পারে। রমজানে সকল পর্যায়ের লোকের উপর দয়া ও মেহেরবানীর অতিরিক্ত দায়িত্ব অর্পিত হয়। সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধানের জনগণের সাথে নম্রতা ও দয়া প্রদর্শন করা উচিত। আয়েশা (রা) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন, ‘হে আল্লাহ! যে ব্যক্তি আমার উম্মাহর শাসনকর্তা নির্বাচিত হওয়ার পর তাদের সাথে কঠোরতা করে তুমিও তার প্রতি কঠোরতা করো, আর যে শাসনকর্তা তাদের সাথে নরম ব্যবহার করে তুমিও তার প্রতি নরম ব্যবহার করো।, (মুসলিম)
সাহাবায়ে কেরাম অভাবী ও গরীবদের প্রতি দয়া ও সহানুভূতি প্রদর্শন করতেন। আবদুল্লাহ বিন ওমর (রা) কোন ফকীর মিসকীন ছাড়া ইফতার করতেন না। তিনি ইফতারের জন্য কোন গরীব লোক না পেলে সেই রাতে না খেয়ে থাকতেন। তিনি খানা খাওয়ার সময় কোন গরীব লোক সাহায্য প্রার্থনা করলে নিজের ভাগের খাবার টুকু দান করে দিতেন। কোন সময় ঘরে ফিরে দেখতেন যে আর কোন খাবার নেই। তখন তিনি না খেযে রাত কাটিয়ে দিতেন।
রমজান সকল নেক কাজের জন্য অধিক সওয়াবের মাস। দান-সদকা রমজানের একটি গুরুত্বকপূর্ণ শিক্ষা ও করণীয়। রোজার উপবাসের মাধ্যমে গরীব-দু:খী মানুষের কষ্ট বুঝার পর তা দূর করার জন্য বাস্তব ব্যবস্থা হলো দান-সদকাহ করা। আর এ কারাণেই নবী করিম (সা) অন্যান্য মাসে বড় দাতা হওয়া সত্ত্বেও রমজানে তিনি আরো বেশী দান করতেন। আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস থেকে বর্ণিত, ‘রাসূলুল্লাহ (সা) এমনিতেই সর্বাধিক দানকারী ছিলেন । কিন্তু তিনি রমজানে জিবরীল (আ)-এর সাতে সাক্ষাতের পর প্রবাহমান বাতাসের মতো উন্মুক্ত হস্ত অধিকতর দাতা হয়ে যেতেন।’ (বোখারী)
আনাস (রা) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেন, ‘রমযানের দান-সদকাহ সর্বোত্তম।’(তিরমিজী)
যে কোন ঈবাদতের সওয়াব নীচে ১০ থেকে শুরু হয় এবং উপরের দিকে ৭শ বা আরো অধিক সম্প্রাসারিত। কিন্তু একমাত্র আল্লাহর পথে দানের সওয়াব নীচে ৭শ থেকে শুরু হয় এবং উপরের দিকে আরো বেশী। ১০ থেকে শুরু হয় না। এটা দাস-সদকার বৈশিষ্ট্য। এ মর্মে আল্লাহ কোরআনে বলেন: ‘যারা আল্লাহর রাস্তা নিজেদের অর্থ-সম্পদ দান করে তাদের দানের উদাহরণ হলো একটি বীজের মতো, যা থেকে ৭টি শিষ বা ছড়া জন্মায়। প্রত্যেটি ছড়ায় একশ করে দানা থাকে। আল্লাহ যাকে ইচ্ছা আরো বেশী দান করেন। আল্লাহ অতি দানশীল ও সর্বজ্ঞ।’ (সূরা বাকারা-১৬১)
আল্লাহ বলেন, তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করো এবং তিনি তোমাদেরকে যে সম্পদের প্রতিনিধি বানিয়েছেন- তা থেকে ব্যয় করো।’ (সূরা হাদীদ-৭)
এ আয়াতে সম্পদের মালিক আলাহ মানুষকে সম্পদের প্রতিনিধি বানিয়ে তা আল্লাহর রাস্তায় ব্যয় করার নির্দেশ দিয়েছেন। আল্লাহ আরও বলেন: ‘আমি তোমাদেরকে যা দিয়েছি, তা থেকে মৃত্যু আসার আগেই ব্যয় করো। আল্লাহ বলেন, তোমরা যদি আল্লাহর উদ্দেশ্য কর্জে হাসানা দাও, তাহলে, আল্লাহ তা বহুগুণে বাড়িয়ে দেবেন এবং তোমাদের গুনাহ মাফ করে দেবেন, আল্লাহ শোকর গুজার ও ধৈর্যশীল।’ (সূরা তাগাবুন-১৭)
দান-সদকাহ দ্বারা গুনাহ মাফ হয়। আল্লাহ বলেন, তোমরা যদি প্রকাশ্যে দান-সদকা করো, তাহলে তা কতইন উত্তম। আর যদি তা গোপনে গরীব ও অভাবীদেরকে দিয়ে দাও, তবে তা তোমাদের জন্য আরো উত্তম। আল্লাহ তোমারে গুনাহ মাফ করে দেবেন। আল্লাহ তোমাদের আমলের বেশী খবর রাখেন। ’(সূরা বাকারা-২৭১)
আবদুুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেন, ‘দান-সদকাহ দ্বারা সম্পদ কমে না। আল্লাহ তা আরো বাড়িয়ে দেন। তোমরা খেজুরের একটি টুকরা দান করে হলেও দোযখ থেকে বাঁচো। যে আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে দান করে তা তাকে জাহান্নাম থেকে আড়াল করবে।’ (তাবারানী)
আবু হোরায়রা (রা) প্রশ্ন করেন, কোন্ দান উত্তম ? রাসূলুল্লাহ (সা) বলেন, গরীবের সামর্থ অনুযায়ী দান। তবে প্রথমে পরিবারে ব্যয় শুরু করো।’
হাদীসে কুদসীতে এসেছে, আল্লাহ বলেন, ব্যয় করো, আমিও তোমার জন্য ব্যয় করবো। নবী (সা) বলেন, তিনটি বিষয়ে আমি শপথ করে বলছি, দান দ্বারা সম্পদ কমে না। এরপর বলেন, দুনিয়ার চার ধরনের লোক আছে। ১. এক বান্দাকে আল্লাহ এলেম ও সম্পদ দিয়েছেন। সে এ ব্যাপারে আল্লাহর আদেশ-নিষেধ মেনে চলে তাকওয়ার অনুসরণ করে, আত্মীয়তার অধিকার পূরণ করে এবং সম্পদে যাদের হক আছে সে হক আদায় করে, তার মর্যাদা সর্বোত্তম। ২. অন্য বান্দাকে আল্লাহ এলেম দিয়েছেন, কিন্তু সম্পদ দেননি। সে সত্য নিয়তে বলে, যদি আমার সম্পদ থাকতো, তাহলে, আমি অমুক অমুক নেক কাজ করতাম। তার নিয়তের কারণে উভয়ের মর্যাদা সমান হবে। ৩. আরেক বান্দাকে আল্লাহ সম্পদ দিয়েছেন, কিন্তু এলেম দেননি, সে এলেম না থাকার কারণে সম্পদের মধ্যে ডুবে আছে, আল্লাহকে ভয় করে তাঁর আদেশ-নিষেধ পালন করে না, আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা করে না এবং সম্পদে আল্লাহর যে অধিকার আছে তা পূরণ করে না। এ ব্যক্তি হলো সর্বনিকৃষ্ট। ৪. এক বান্দাকে আল্লাহ অর্থ ও এলেম কিছুই দেননি। সে বলে, যদি আমার অর্থ-সম্পদ থাকতো, তাহলে আমি অমুক (গুনাহর) কাজ করতাম। তার নিয়তের কারণে উভয় ব্যক্তির সমান গুনাহ হবে।
আবু হোরায়রা (রা) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেন: সে দান উত্তম, যখন তুমি সুস্থ এবং সম্পদ কামনা করো ও দারিদ্র্যের ভয় করো। মৃত্যু ওষ্ঠাগত অবস্থা পর্যন্ত দেরী করো না; তখন যেন এরুপ না বলতে হয় যে, অমুকের জন্য এটা, অমুুকের জন্য সেটা এবং অমুকের জন্য ওটা।,(বোখারী ও মুসলিম)
প্রকৃত অর্থে দানের বহু উপকারিতা আছে। এতে গুনাহ মাফ হয়, মর্যাদা বাড়ে, জাহান্নাম থেকে আড়াল হয়, সম্পদ বাড়ে ও বরকত নাযিল হয়, হাশরের ময়দানে ছায়া হবে, অমঙ্গলের দরজা বন্ধ হয়, খারাপ মৃত্যু থেকে বাঁচা যায়। দান করলে ফেরেশতারা বিনিময়ের জন্য দোয়া করেন ইত্যাদি। তাছাড়া দানের মাধ্যমে সর্বাধিক সওয়াব পাওয়া যায় যা আর কোন ইবাদতে নেই। দানের সর্বনিু সওয়াব হল ৭শ গুণ। দানের দ্বারা অভাবী মানুষ তৃপ্ত হয় এবং তারা দাতার জন্য দোয়া করে। ফেরেশতারা পর্যন্ত দোয়া করে। আল্লাহ আমাদের দানশীল হওয়ার তওফীক দিন। আমীন!