মুক্তিযুদ্ধে লক্ষ্মীছড়ি: ৬ ডিসেম্বর উড়ানো হয় লাল-সবুজের পতাকা

শেয়ার করুন

কিন্তু কী ঘটেছিল সেই দিন?
তৎকালীন সময়ে লক্ষ্মীছড়ি ছিল ছোট একটি দুর্গম ইউনিয়ন। যোগাযোগব্যবস্থা দুর্বল হওয়ায় এখানকার লোকজন তদ্রূপ অবহিত ছিল না। সেকারণে লক্ষীছড়ি উপজেলায় মুক্তিযুদ্ধের প্রভাব পড়ে অনেক পরে। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার কয়েক মাস পর এ উপজেলার মানুষ যুদ্ধের ব্যাপারে সচেতন হয়ে ওঠে। মো. ফজলে বারী নামক জনৈক বাঙালি পাহাড়ি সম্প্রদায়ের লোকজনকে যুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য উদ্বুদ্ধ করেন।
স্থানীয়ভাবে কোনো প্রশিক্ষণ শিবির না থাকায় অনেকেই ভারত গিয়ে প্রশিক্ষণ নেন। তবে যুদ্ধজুড়ে পাহাড়ি ও বাঙালি উভয় সম্প্রদায়ের মানুষ মুক্তিবাহিনীকে নানা উপায়ে সহযোগিতা করেন।

লক্ষ্মীছড়ি মুক্তিবাহিনীর যাতায়াত ও সমন্বয়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ রুট হয়ে ওঠে। যে-সকল পাহাড়ি বাঙালি মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা করেন, তাদের মধ্যে বাইন্যাছোলা পাড়ার সূর্যসেনের বাপ, কৃষ্ণ কুমার চাকমা, তেস্বী মহাজন (তেজেন্দ্র লাল চাকমা), ও ফুল কুমার চাকমা, সাধন কুমার চাকমা, ডিপি পাড়া গ্রামের সুলতানা মাঝি, আলী মিয়া মাতব্বর, আবুল কাসেম ও সাংবাদিক মোহাম্মদ আলী, সাওতাল পাড়ার মানিক সিং সাওতাল, উপজেলা সদরের মনোরাম কার্বারী, দেওয়ান পাড়ার গুজেন্দ্র চাকমা ও পিয়ারী হেডম্যান, চাইল্যাতলীর লাইয়া মহাজন বার্মাছড়ির বাকছড়ি পাড়ার রবি ভূষণ চাকমা ও কুসুম মালার বাপ, তাদের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য আরও নাম নাজানা অনেকেই সহযোগিতায় ছিলেন। এদের মধ্যে মুক্তিযোদ্ধাদের ভারতে আনা-নেয়ার কাজে সার্বক্ষণিকভাবে নিয়োজিত ছিলেন তেস্বী মহাজন (তেজেন্দ্র লাল চাকমা), লাইয়া মহাজন ও গুজেন্দ্র চাকমা। প্রমুখ মুক্তিযোদ্ধাদের নিরাপদ চলাচল, ভারত পর্যন্ত যাতায়াত এবং বিভিন্ন স্থানে আশ্রয় দিতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখেন।

জুলাইয়ের শুরুতে পাকবাহিনী প্রথমবারের মতো লক্ষ্মীছড়িতে আক্রমণ চালায়। স্থায়ী ক্যাম্প না থাকলেও তারা মানিকছড়ি থেকে নিয়মিত এসে অভিযান চালাত। মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তার অভিযোগে পাকসেনারা সুরপতি চৌধুরীকে হত্যা করে এবং দেওয়ানপাড়ার ‘চিকমা’ নামে এক নারীকে ধরে নিয়ে নির্যাতন চালায়। মেজরপাড়া যুদ্ধের পর পাকবাহিনী দোজরী পাড়ার পাহাড়িদের ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেয়।

রাঙ্গুনিয়া, ফটিকছড়ি ও কাঞ্চনপুর থেকে আসা প্রায় ৩০-৩৫ জন মুক্তিযোদ্ধার একটি দল মেজরপাড়ায় পাকবাহিনীর সঙ্গে মুখোমুখি হয়। আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত পাকসেনাদের টানা গুলিবর্ষণে মুক্তিযোদ্ধারা পিছু হটতে বাধ্য হন। এ যুদ্ধে রাঙ্গুনিয়ার কবির আহমেদ গুলিবিদ্ধ হন এবং পরদিন স্থানীয়দের সহায়তায় তাঁকে উদ্ধার করা হয়।
পরবর্তীতে মুক্তিবাহিনী খীরাম এলাকায় ক্যাম্প স্থাপন করে এবং বিভিন্ন সীমান্ত এলাকা দিয়ে যুদ্ধার্থে নতুন যোদ্ধাদের গোপনে দেশে আনার দায়িত্ব পালন করে।

আগস্টের শেষদিকে পাকবাহিনী হাতিতে অস্ত্র ও গোলাবারুদ তুলে লক্ষ্মীছড়ির উদ্দেশে এগোয়। মেজরপাড়ার দুই পাহাড়ের মাঝখানে মুক্তিযোদ্ধারা তাদের ওপর হামলা চালালে প্রায় দুই ঘণ্টার যুদ্ধ হয়। দুই পাকসেনা নিহত হয়, অস্ত্রশস্ত্র ফেলে বাকিরা মানিকছড়ির দিকে পালিয়ে যায়। একজন মুক্তিযোদ্ধা এ যুদ্ধে আহত হন।

লক্ষ্মীছড়ির মুক্তিযোদ্ধা গ্রুপগুলোর নেতৃত্বে ছিলেন মো. সরোয়ার কামাল, অনিল মহাজন, জয়নাল আবেদীন মিন্টু ও সুবাস দাশ। সুবাস দাশ ত্রিপুরা রাজ্যে প্রশিক্ষণ নিয়ে একাধিক যুদ্ধে অংশ নেন।

১৯৭১ সালের ৬ ডিসেম্বর লক্ষ্মীছড়ি পাকিস্তানি বাহিনীর নিয়ন্ত্রণমুক্ত হয়। এদিন স্থানীয় কয়েকজন ব্যবসায়ী যাদের মধ্যে নজির সওদাগর ও বাবুল সওদাগর উল্লেখযোগ্য বর্তমান থানা এলাকার ছোট ইপিআর ফাঁড়িতে প্রথম লাল-সবুজের পতাকা উত্তোলন করেন।

এ উপজেলায় তথ্য সূত্র মতে সরাসরি যুদ্ধে অংশ গ্রহন করেছেন বীর মুক্তিযোদ্ধা অনিল কান্তি মহাজন (সাঁওতাল পাড়া), বীর মুক্তিযোদ্ধা সুভাষ দাশ (বাইন্যাছোলা), বীর মুক্তিযোদ্ধা ধর্মচরণ চাকমা (গলাছড়ি) এবং বর্তমানে উপজেলার মধ্যে গেজেটেড তালিকা ভুক্ত অনুসারে মুক্তিযোদ্ধা রয়েছেন ৯ জন তাদের মধ্যে ক্রমানুসারে: ১, খন্দকার অঃ ওহাব (লক্ষীছড়ি বাজার) ২, আব্দুল গনি (মগাইছড়ি)
৩, ফজলুল হক (মগাইছড়ি নতুন পাড়া) ৪, আবুল হাসেম মোল্লা (লক্ষীছড়ি গুচ্ছগ্রাম) ৫, নূর মোহাম্মদ (মহিষকাটা) ৬ নূরুল ইসলাম মাস্টার (জুর্গাছড়ি) ৭, ফজুলর রহমান (জুর্গাছড়ি) ৮, ধর্মচরণ চাকমা (গলাছড়ি) ৯ আবদুল খালেক (ময়ূরখীল)

তথ্য সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৯ম খণ্ড, মুক্তিযোদ্ধাদের সমন্বিত তালিকা, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় ও পাহাড়ের আলো প্রথম সংখ্যা ২০১৪(অংশ বিশেষ)।