• January 13, 2025

আজ ক্যাপ্টেন আফতাবুল কাদের বীর উত্তমের ৪৬তম শাহাদাৎ বার্ষিকী

স্টাফ রিপোর্টার: ক্যাপ্টেন আফতাবুল কাদের (ইকবাল) পার্বত্যঞ্চলের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয় নাম। ১৯৭১ সালের ২৭ এপ্রিল খাগড়াছড়ির মহালছড়িতে পাকবাহিনী সাথে এক প্রচন্ড সম্মুখযুদ্ধে তরুণ বীরমুক্তিযোদ্ধা ক্যাপ্টেন আফতাবুল কাদের বীর উত্তম শাহাদাৎ বরণ করেন।  ক্যাপ্টেন আফতাবুল কাদের (ইকবাল) জন্ম ১৯৪৭ সালে ২৫ ডিসেম্বর দিনাজপুর শহরে। তবে পৈত্রিক  গ্রামের বাড়ি লক্ষীপুর জেলার (তৎকালীন বৃহত্তর নোয়াখালী) রামগঞ্জ থানাধীন টিওড়া গ্রামে। পিতা স্থায়ী নিবাস গড়ে তোলেন পুরাতন ঢাকার ফরিদাবাদ এলাকার লাল মোহন পোদ্দার লেনে। সেখানেই অকুতোভয় এই সৈনিকের শৈশব কাটে। পিতা মরহুম আবদুল কাদের ছিলেন ইংরেজ আমলের একজন ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট, মাতা রশন আরা বেগম ছিলেন গৃহীনি। ১৯৬৪ সালে ময়মনসিংহ শহরের মৃত্যুঞ্জয় স্কুল থেকে এসএসসি এবং ১৯৬৬ সালে আনন্দ মোহন কলেজ থেকে এইচএসসি পাশ করে ইংরেজিতে স্নাতক (সম্মান) এ ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে।
মুক্তিযোদ্ধের এই অকুতভয় বীর সেনালী ক্যাপ্টেন আফতাবুল কাদের (ইকবাল) ১৯৬৭ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। ১৯৬৯ সালে আর্টিলারি কোরে কমিশন প্রাপ্ত হন এবং ১৯৭০ সালে হায়দ্রাবাদ ক্যান্টনমেন্টে ৪০ ফিল্ড আর্টিলারি রেজিমেন্টে ক্যাপ্টেন হিসেবে যোগ দেন।
১৯৭১ সালে ৫শে ফেব্রুয়ারী সংসার নামে একটি ছোট ঘর বাঁধার স্বপ্ন নিয়ে সরকারী কর্মস্থল পাকিস্তানের হায়দ্রাবাদ থেকে ছুটিতে নিজবাড়ী ঢাকায় এসেছিলেন ৪০ ফিল্ড রেজিমেন্টের সেনা অফিসার ক্যাপ্টেন আফতাবুল কাদের। মা প্রাণের টুকরো সন্তানের জন্য ঘরণী করে আনেন এক সুন্দরী বউ। প্রিয়তম স্ত্রী আর কাদের এর হাতে লাগানো বিয়ে মেহেদীর রঙ তখনো ম্লান হয়ে যায়নি। বড় ভাই সিরাজুল কাদের রাজুর মুখে ২৫শে মার্চ কালো রাত থেকে দিনের পর দিন নিরীহ বাঙালীর উপর পাকবাহিনীর নির্মম অত্যাচার, গণহত্যার প্রত্যক্ষ বিবরণ শুনে এবং স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে প্রচারিত স্বাধীনতা ঘোষণা শুনে বদ্ধ ঘরে স্থির থাকতে পারেননি তরুন অফিসার। পাক হানাদারদের নির্মম কর্মকান্ডের তীব্র ্র ক্ষোভ, প্রতিরোধ আর পরাধীনতার শৃঙ্খল ভাঙার দৃঢ় প্রত্যয়ে প্রিয় ঘর, ঘরণীর মধুর বন্ধন ছিন্ন করে তরুণ সেনা অফিসার ঝাঁপিয়ে পড়েন মুক্তিযুুদ্ধে। পরবর্তীতে ২৮ শে মার্চ মাকে বন্ধুর বাসায় যাবার কথা বলে যুদ্ধে অংশ নিতে চট্টগ্রামের পথে বেরিয়ে আসেন এবং ফেনীর শুভপুর যুদ্ধে ইপিআর বাহিনীর সাথে যোগ দেন।
২রা এপ্রিল রাতে ক্যাপ্টেন কাদের সীমান্ত শহর রামগড়ে পর্দাপন করে মেজর জিয়ার নেতৃত্বাধীন এক নম্বর সেক্টরে যোগদান করে শুরু করেন শত্রু মোকাবিলার কর্মব্যস্ততা। রামগড় কে শত্রুমুক্ত রাখার লক্ষ্যে তিনি ইপিআর হাবিলদার কাশেম এর প্লাটুনসহ ৫ই এপ্রিল সফল অপারেশন চালিয়ে ধুমঘাট রেলওয়ের ব্রিজ উড়িয়ে দেন । প্রায় ৫ শতাদীক সংগ্রামী তরুণ অস্ত্র ট্রেনিং দেয়ার জন্য জড়ো হয় রামগড় সরকারী উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে। এতদিন বেঙ্গল রেজিঃ আর ইপিআর (ইস্ট পাকিস্তান রাইফেল্স) যুদ্ধ করে গেছে পাকহানাদার বাহিনীর সাথে এবার করবে বাংলার তরুণ সমাজ। ক্যাপ্টেন কাদের নিজেই প্রশিক্ষণার্থীদের দায়িত্ব ভার গ্রহণ করেন। তাঁর সহযোগী ছিলেন ইপিআর সুবেদার এ.কে.এম. মফিজুল বারি (বিডিআর এর প্রথম উইং কমান্ডার) এবং কয়েকজন ইনস্ট্রাকটকে প্লাটুনে ভাগ করে দেয়া হয়। মুক্তিযুদ্ধের ১নং সেক্টর্রের রামগড় সরকারী উচ্চ বিদ্যালয় মাঠের এ ট্রেনিং থেকে শতশত মুক্তিকামী যুবক দুঃসাহসী যোদ্ধা হিসেবে গড়ে  উঠে শত্রুদের সম্মুখ যুদ্ধে প্রতিরোধে ঝাঁপিয়ে পড়েন।
১০ এপ্রিল মেজর জিয়া, লেঃ খালেকুজ্জামানসহ ক্যাপ্টেন কাদের ৫০ জনের একটি গ্রুপের সাথে খাগড়াছড়ির উদ্দেশ্যে রামগড় ত্যাগ করেন। তিনি তার গ্রুপসহ মহালছড়ি, রাঙ্গামাটি, মানিকছড়ি, বিভিন্ন স্থানে বিচরণ করেন। রাঙ্গামাটি বন্ধুকভাঙ্গা নামক স্থানে অবস্থান কালে তাঁরা প্রায় দুই লঞ্চ বোঝাই পাকবাহিনীর হাতে বাধা গ্রস্থ হয়। প্রায় দুই ঘন্টা এ যুদ্ধে এই দ্বীপে শক্রপক্ষের বেশ কয়েক জন সৈন্য মারা যায়।
শেষ পর্যন্ত পিছু হটতে বাধ্য হয় পাকবাহিনীর সদস্যরা। এদিকে পাকসেনারা নিজেদের দলভারী করার জন্য হাজার হাজার মিজোদের তাদের দলে অন্তভুক্ত করে প্রশিক্ষণ দেয়। আর মুক্তি যোদ্ধাদের গুরুত্বপূর্ণ সকল ঘাঁটির উপর বিমান হামলা শুরু করে। এদিকে মুক্তিবাহিনীর রসদ এবং গোলা বারুদ শেষ হবার পথে, তাছাড়া মুক্তি যোদ্ধাদের অধিকাংশেরই ছিলোনা পাহাড়ী এলাকায় কোন যুদ্ধের পূর্ব প্রশিক্ষণ। মুক্তি যোদ্ধারা পরবর্তীতে পজিশন দুর্বল হয়ে পড়ে প্রায়। ঠিক এই নাজুক পরিস্থিতিক্ষণে ২৭ শে এপ্রিল সকালে মহালছড়িতে অবস্থানকারী মুক্তিযোদ্ধারা আক্রান্ত হয় শত্রু বাহিনীর হাতে। শত্রুরা ছিলো দলে ভাড়ী ও একটি নিয়োমিত কমান্ডো কোম্পানী আর ছিলো ১৫-১৬ শ মিজোর দুটি ব্রিগ্রেড। যা মুক্তিযোদ্ধাদের সংখ্যার চেয়ে দু’তিন গুন বেশি। ক্যাপ্টেন কাদের ছিলেন রাঙ্গামাটি রেকীতে। রেকী শেষে মেজর শওকতের প্লান অনুযায়ী ক্যাপ্টেন কাদের যোগদেন মহালছড়িতে তুমুল যুদ্ধে।
কিছুটা পিছু হটতে শুরু করে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত জীবন বাঁচানোর তাগিতে পাক হানাদাররা বেপরোয়া হয়ে ওঠে। তারা মিজোদের সামনে রেখে একটার পর একটা আক্রমন চালিয়ে সামনে অগ্রসর হয়। মুক্তি যোদ্ধাদের পাল্টা আক্রমনে মিজোরা পিছু হটতে চাইলে পাকবাহিনীরা এমন ভাব দেখাত যে, পিছু হটতে চাইলে তারা নিজেরাই মিজোদের হত্যা করবে। তারা এক রকম উম্মাদ হয়ে ওঠে। শত্রুরা মুক্তিযুদ্ধাদের ঘিরে ফেলে এবং মুক্তিযোদ্ধারা বিপদেপড়ে যায়। গর্জে ওঠে পাক-বাহিনীর মেশিন গান, ক্যাপ্টেন কাদের লুটিয়ে পড়েন মাটিতে, যুদ্ধ দু’পক্ষের মধ্যে চলছেই। তখন সহযোদ্ধা, শওকত আলী এবং সিপাহী ড্রাইভার আব্বাস আহত ক্যাপ্টেন কাদের কে বহন করে নিরাপদে একটি জীপযোগে রামগড় আনার পথে গুইমারায় আহত কাদেরকে পান করানো হয় জীবনের শেষ পানি। ২৭ শে এপ্রিলের বিকালে শহীদ বীরযোদ্ধা ক্যাপ্টেন কাদের এর পবিত্র মরদেহ রামগড় নিয়ে আসা হয়। সকলের চোখে মুখে নামে শোকের ছায়া। সন্ধ্যার প্রাক্কালে রামগড় কেন্দ্রীয় মসজিদ প্রাঙ্গনে ইমাম মাওলানা মোহাম্মদ মোস্তফার পরিচালনায় শহীদ ক্যাপ্টেন আফতাবুল কাদেরের জানাজা নামাজ শেষে কেন্দ্রীয় কবরস্থানে পূর্ণ সামরিক ও ধর্মীয় মর্যাদায় দাফন করা হয়।
মুক্তিযুদ্ধের অসাধারণ ও গৌরবোজ্জ্বল অবদানের স্বীকৃতির স্বরূপ ১৯৭৩ সালে সরকার ক্যাপ্টেন আফতাবুল কাদেরকে মরণোত্তর ‘বীর উত্তম’ উপাধিতে ভূষিত করেন। তাঁর নামে স্মৃতি সৌধ (খাগড়াছড়ি), ভার্স্কয (মহালছড়ি), কেজি স্কুল (রামগড়), রামগড় ১৬ বর্ডার গার্ড ব্যাঃ উদ্যোগে রাস্তার নাম করণ (রামগড়) করা হয়েছে। রামগড়ে চির নিদ্রায় শায়িত বীরযুদ্ধা ক্যাপ্টেন আফতাবুল কাদের মরণোত্তর “বীর উত্তম” উপাধিতে ভূষিত করা হলেও তাঁর নামে আজো কোন স্মৃতি জাদুঘর প্রতিষ্ঠান করা হয়নি। এ ব্যাপারে সংশি¬ষ্ট কর্তৃপক্ষে সু-দৃষ্টিসহ পার্বত্য চট্টগ্রামবাসীর দাবী শিঘ্রই রামগড়ে তার নামে একটি স্মৃতি যাদুঘরসহ একটি উচ্চতর শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করার জোর দাবী জানান।

পাহাড়ের আলো

https://pahareralo.com

সর্বাধিক জনপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল। সর্বশেষ সংবাদ সবার আগে জানতে চোখ রাখুন পাহাড়ের আলোতে।

Related post