ফের অস্থিরতা বেড়েছে পাহাড়ে

স্টাফ রিপোর্টার: ভালো নেই পাহাড়। নতুন করে দানা বেঁধেছে হিংসা। অভ্যন্তরীণ কোন্দল, দলে বিভক্তি, আধিপত্য বিস্তার ও মতের ভিন্নতার জেরে পাহাড়ের বিবদমান দলগুলো জড়িয়ে পড়েছে সংঘাত-হানাহানিতে। খুন, অপহরণ, গোলাগুলির মত ঘটনায় শংকিত পাহাড়ের মানুষ।

মাঝখানে বেশ কয়েক বছর ভ্রাতৃঘাতী সংঘাত বন্ধ থাকলেও এখন আবার ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ) বিভক্ত হওয়ার পর থেকে দলগুলো সংঘাতে জড়িয়ে পড়েছে। তবে একের পর এক ঘটনা ঘটে গেলেও দলগুলো দায় চাপানোর রাজনীতি নিয়েই ব্যস্ত। শুধু গত ১১ এপ্রিল থেকে ২২ এপ্রিল পর্যন্ত ১২দিনে খাগড়াছড়ি ও রাঙ্গামাটি-খাগড়াছড়ির সীমান্তঘেঁষা নানিয়ারচর ও মারিশ্যাতে ৭ জন খুন হয়েছেন। তবে একটি সূত্র বলছে, খুনের সংখ্যা আরো বেশি। ৪ টি অপহরণের ঘটনা ঘটেছে। বিবদমান গ্রুপগুলোর মধ্যে গোলাগুলির ঘটনাও ঘটেছে। সর্বশেষ গত ২২ এপ্রিল পানছড়ির মরাটিলা এলাকায় ইউপিডিএফ প্রসীত গ্রুপের গুইমারা ও মাটিরাঙ্গা ইউনিট প্রধান সুনীল বিকাশ চাকমা (৪০) প্রতিপক্ষের গুলিতে নিহত হন। এই ঘটনায় একজন আহত হয়। একই দিন বিকালে খাগড়াছড়ির জেলা সদরের কমলছড়ি এলাকা থেকে পিতাপুত্রসহ ৩ জনকে অপহরণের অভিযোগ করেছে ইউপিডিএফ।

এর আগে গত ১৮ এপ্রিল নিখোঁজ হওয়ার ৪ দিনের মাথায় মাটিরাঙ্গার ভাঙ্গামুড়া এলাকা থেকে নতুন কুমার ত্রিপুরা (৩২) নামে এক ব্যক্তির লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। ১৬ এপ্রিল জেলা শহরের পেরাছড়ায় সূর্য বিকাশ চাকমা (৪৫) নামে এক ব্যক্তিকে গুলি করে হত্যা করা হয়। ১৫ এপ্রিল দীঘিনালা মারিশ্যা সড়কে তপন চাকমা (৪০) ও বিজয় চাকমা(৩২) নামে দুজনকে হত্যার হত্যার কথা শোনা যায়। এছাড়া রাঙ্গামাটির নানিয়ারচরে ১১ ও ১২ এপ্রিল জনি তঞ্চঙ্গা(৩২) এবং সাধারণ চাকমা(৪০) খুন হন। গুলি ও ছুরিকাঘাতে আহতের সংখ্যাও নেহায়েত কম নয়। এছাড়া গত ১৫ এপ্রিল বাড়ি ফেরার পথে দীঘিনালা বাস স্টেশন থেকে নিখোঁজ হন কলেজছাত্র জেরান চাকমা (২১)। ১৬ এপ্রিল মহালছড়ির মাইছড়ি এলাকায় কাঠ কিনতে যাওয়ার পর থেকে নিখোঁজ তিন জন। তারা হলেন কাঠ ব্যবসায়ী মোঃ সালাউদ্দিন(২৮), একই এলাকার মহরম আলী (২৭) ও ট্রাকচালক বাহার মিয়া। এই ঘটনা উত্তাপ ছড়াচ্ছে পাহাড়ে। ইতিমধ্যে বিক্ষোভ মিছিল, সমাবেশ ও হরতালের মত কর্মসূচি পালন করা হয়েছে।

আঞ্চলিক দলগুলোর বিরোধের জেরে খাগড়াছড়িতে প্রায় দেড়শ পরিবার নিজ বসতবাডি ছেড়ে উদ্বাস্তু হয়েছে। এর মধ্যে খাগড়াছড়ির লক্ষ্মীছড়ির বর্মাছড়ি, গুইমারা, রাঙ্গামাটির নানিয়ারচরের উদ্বাস্তু ৪৪টি পরিবার বর্তমানে মহালছড়ির সিঙ্গিনালা কুলারামপাড়া হাই স্কুলসহ আশপাশের এলাকায় অন্যের বাসাবাড়িতে বসবাস করছে। গত ২০ এপ্রিল প্রশাসনের পক্ষ থেকে তাদের ত্রাণ সহায়তা দেয়া হয়েছে। এছাড়া উদ্বাস্তু অন্য পরিবারগুলো বসতভিটা ছেড়ে অন্যত্র অবস্থান করছে। শুধু তাই নয়, দীঘিনালা, পানছড়ি, রামগড়, মাটিরাঙ্গায় প্রতিপক্ষের বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ-ভাংচুরের মতো ঘটনা ঘটেছে। তবে জানুয়ারি থেকে হিসেব করতে গেলে এই খুন, অপহরণের সংখ্যা আরো বেশি।

প্রসঙ্গত, পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির শীর্ষ নেতা ও আঞ্চলিক পরিষদ চেয়ারম্যান জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা ওরফে সন্তু লারমার নেতৃত্বের প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে ২০১০ সালের প্রথম দিকে সংগঠনটি দ্বিধাবিভক্ত হয়। এমএন লারমাপন্থী বলে পরিচয় দিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির আরেকটি অংশের আত্মপ্রকাশ ঘটে। তখন ‘ইউপিডিএফ’ এর সাথে এমএন লারমাপন্থী জনসংহতি সমিতির সম্পর্ক ভালোই কাটছিল। দীর্ঘদিনের সখ্য উবে গিয়ে এই দুই সংগঠনের মধ্যে নতুন করে সংঘাত-সংঘর্ষ, অপহরণের মত ঘটনা ঘটছে। অন্যদিকে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির পর থেকে সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন জনসংহতি সমিতির সাথে ইউপিডিএফ এর মধ্যে ভ্রাতৃঘাতী সংঘাত লেগে থাকলেও গেলো দু‘বছরের মধ্যে পার্বত্য চুক্তির পক্ষ-বিপক্ষের বিবদমান সংগঠন দুটির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হানাহানির ঘটনা ঘটেনি।

২০১৭ সালের ১৫ নভেম্বর খাগড়াছড়ি জেলা সদরের খাগড়াপুর কমিউনিটি সেন্টারে সাংবাদিক সম্মেলনের মাধ্যমে প্রসীত বিকাশ খীসার নেতৃত্ব প্রত্যাখ্যান করে তপন কান্তি চাকমাকে আহবায়ক ও জলেয়া চাকমা কে সদস্যসচিব করে ১১ সদস্যের নতুন দল ‘ইউপিডিএফ গণতান্ত্রিক’’র আত্মপ্রকাশ ঘটে। অন্যদিকে নতুন এই সংগঠনকে ‘নব্য মুখোশবাহিনী’ আখ্যায়িত করে প্রতিরোধের ঘোষণা দেয় প্রসীত খীসার নেতৃত্বাধীন ইউপিডিএফ। এরপর থেকে শুরু হয় সংঘাত। ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ-গণতান্ত্রিক) এর সদস্য সচিব জলেয়া চাকমা বলেন, প্রসীত খীসার ইউপিডিএফ জুম্ম জনগণের অধিকার আদায়ের বুলি আওড়ালেও তারা এখন লক্ষচ্যুত। তারা এখন ভ্রাতৃঘাতী সংঘাত, আধিপত্য বিস্তার ও চাঁদাবাজির মত ঘটনায় জড়িয়ে পড়েছে। তারা গণতান্ত্রিক পন্থার পরিবর্তে জোর জবর দস্তিতে দলীয় কার্যক্রম চালাতে চায়। তারা এখন সন্ত্রাসী সংগঠন।

পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (এমএন লারমা গ্রুপ)’র কেন্দ্রীয় তথ্য ও প্রচার সম্পাদক সুধাকর ত্রিপুরা বলেন, ‘রক্তপাত করে অধিকার আদায় হবে না। অধিকার আদায় করতে হলে সম্মিলিত প্রচেষ্টা লাগবে। কিন্তু  ইউপিডিএফ (প্রসীত) এতে বিশ্বাসী না বলে পাহাড়ে সন্ত্রাসী কর্মকান্ড চালাচ্ছে। আমাদের বহু নেতাকর্মী তাদের হাতে মারা গেছে। অপহৃত হয়েছে। বাড়িছাড়া হয়েছে।
তবে প্রসীত খীসার ইউপিডিএফ এর মুখপাত্র নিরণ চাকমা বলেন, ‘নব্য মুখোশবাহিনী (ইউপিডিএফ-গণতান্ত্রিক) ও জেএসএস সংস্কার টার্গেট কিলিংয়ে নেমেছে। তারা আমাদের নেতাকর্মীদের একের পর এক হত্যা, অপহরণ করে যাচ্ছে। তাঁরা যদি মনে করে খুন করে ইউপিডিএফ নেতাকর্মীদের দমানো যাবে তাহলে ভুল করবে।’  চলতি বছর ১০জন নেতাকর্মীকে হত্যা ও ১জনকে অপহরণ করা হয়েছে বলে জানান তিনি।

এদিকে গত সোমবার (২৩ এপ্রিল) খাগড়াছড়ি টাউন হলে আয়োজিত এক সভায় শরণার্থী বিষয়ক টাস্কফোর্সের চেয়ারম্যান ও স্থানীয় সংসদ সদস্য কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা বলেন, ‘পাহাড়ের মানুষ এখন ভালো নেই। একের পর সংঘাতের কারণে মানুষ আতঙ্কিত।’ তিনি সবাইকে সজাগ থাকার এবং সংঘাত বন্ধের আহ্বান জানান।

এ বিষয়ে খাগড়াছড়ির অতিরিক্ত পুলিশ সুপার এমএম সালাউদ্দিন জানিয়েছেন, ‘এসব ঘটনা ঘটার পরও পরিবারগুলো থেকে তেমন কোনো অভিযোগ দায়ের করা হয় না। তবে কোনো অবস্থাতেই সন্ত্রাসী কর্মকান্ডকে প্রশ্রয় দেয়া হবে না। আমরা সতর্ক রয়েছি। প্রয়োজন অভিযানও চালানো হচ্ছে।’স্থানীয় জনগণের প্রত্যাশা, সংঘাত বন্ধ করে পাহাড়ে শান্তি ধরে রাখতে সবাই একসাথে কাজ করবেন।

Read Previous

আজ ক্যাপ্টেন আফতাবুল কাদের বীর উত্তমের ৪৬তম শাহাদাৎ বার্ষিকী

Read Next

মানিকছড়িতে ‘ন্যাশনাল সার্ভিস একতা কল্যাণ পরিষদ’র কমিটি গঠন