• November 21, 2024

করোনা মোকাবিলায় কীভাবে সফল ভারতের কেরালা?

ঢাকা অফিস: করোনা মোকাবিলায় দুর্দান্ত সাফল্য দেখিয়েছে ভারতের কেরালা রাজ্য। ভারতের প্রথম করোনা আক্রান্ত এই রাজ্যে শনাক্ত হলেও এখন সর্বোচ্চ আক্রান্ত রাজ্যের মধ্যে কেরালার অবস্থান অষ্টম।

শনিবার পর্যন্ত, কেরালায় মোট আক্রান্তের সংখ্যা ৩৬৪। মারা গেছেন দুই জন। সুস্থ হয়ে উঠেছেন ১২৩ জন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কঠোর ব্যবস্থার পাশাপাশি মানবিক দৃষ্টিভঙ্গিই মূলত কেরালার সাফল্যের মূলমন্ত্র।

কেরালার সামগ্রিক পরিস্থিতি ও উদ্যোগ নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট।

ওয়াশিংটন পোস্ট জানায়, ব্যাপক হারে স্বাস্থ্য পরীক্ষা, আক্রান্তদের সংস্পর্শে আসাদের দ্রুত খুঁজে বের করা, দীর্ঘ সময় কোয়ারেন্টিন ব্যবস্থার পাশাপাশি হঠাৎ লকডাউনের কারণে আটকে পড়া কয়েক হাজার অভিবাসী শ্রমিকদের জন্য আশ্রয়ের ব্যবস্থা ও কয়েক লাখ শ্রমিকের কাছে নিয়মিত খাবার পৌঁছানোর মতো মানবিক উদ্যোগের কারণেই করোনা মোকাবিলায় সফল হয়েছে কেরালা।

কেরালার প্রায় ৩০ হাজার স্বাস্থ্যকর্মী প্রতিনিয়ত মানুষের সেবায় কাজ করে চলেছেন। এমনই একজন স্বাস্থ্যকর্মী শিবা টিএম। প্রতিদিন হোম কোয়ারেন্টিনে থাকা একেকজনের তথ্য সংগ্রহ করেন তিনি। শারীরিক ও মানসিক অবস্থা কেমন, বাসায় পর্যাপ্ত খাবার আছে কিনা—এসব তথ্য সংগ্রহ করে কোয়ারেন্টিনে থাকা মানুষদের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হয় বলে জানান তিনি।

কেরালার স্বাস্থ্যমন্ত্রী কে কে শৈলজা বলেন, ‘আমরা সবচেয়ে মারাত্মক পরিস্থিতির কথা মাথায় রেখে নিজেদের সর্বোচ্চটুকু দেওয়ার চেষ্টা করছি। এখন পর্যন্ত আক্রান্তের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণে আছে। তবে, আগামী সপ্তাহে কী হবে তা বলা যাচ্ছে না। তাই এখনই স্বস্তির কোনো সুযোগ নেই।’

অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা

ভারতে এখন পর্যন্ত মোট আক্রান্তের সংখ্যা ৮ হাজার ৫০০, মারা গেছেন ২৮৯ জন। শনাক্তকরণ পরীক্ষা, দরিদ্রদের জন্য পর্যাপ্ত ব্যবস্থাসহ নানা পদক্ষেপের কারণে করোনা মোকাবিলায় কেরালা এখন ভারতের মডেল।

ভাইরোলজিস্ট ও সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ শহিদ জামিল বলেন, ‘সংক্রামক রোগের মহামারি ঠেকানোর উপায় হচ্ছে ব্যাপক হারে পরীক্ষা, আইসোলেশন, সংস্পর্শে আসাদের শনাক্তকরণ ও প্রয়োজনীয় চিকিৎসা। সবকটিতেই কেরালা দুর্দান্ত সাফল্য দেখিয়েছে। একদিকে যেমন অত্যন্ত কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছে, অন্যদিকে মানবিকতাও দেখিয়েছে। এ কারণেই তাদের উদ্যোগ কার্যকর।’

বিবিসি জানায়, এর আগে নিপাহ ও জিকা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব ঠেকানোর অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়েই করোনাভাইরাসের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় কেরালা সফল।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ভারত প্রতিনিধি হ্যাংক বেকেডাম জানান, অতীত অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে কেরালা মহামারির তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় জরুরি পদক্ষেপ নিয়েছিল। সেখানকার সরকার জেলা পর্যবেক্ষণ, ঝুঁকিতে থাকা গ্রুপের প্রতি অধিক মনোযোগের মতো প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিয়েছে।

শুরু থেকেই কঠোর ব্যবস্থা

গত জানুয়ারিতে ভারতের কেরালা রাজ্যে প্রথম তিন জন করোনা রোগী শনাক্ত হয়। কেরালায় আক্রান্ত ওই তিন জনই চীনের উহানের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। এরপরই চীন থেকে আসা যাত্রীদের জন্য বাধ্যতামূলকভাবে কোয়ারেন্টিন চালু করে কেরালা কর্তৃপক্ষ।

ওয়াশিংটন পোস্ট জানায়, এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে আগের তুলনায় রাজ্যটিতে করোনা আক্রান্তের হার কমেছে ৩০ ভাগ।

কেরালায় বছরে প্রায় ১০ লাখেরও বিদেশি পর্যটক ঘুরতে যায়। ৩৩ লাখ জনসংখ্যার প্রদেশটির ছয় ভাগের একভাগ প্রবাসী নাগরিক। সেখানকার কয়েক হাজার শিক্ষার্থী চীনে পড়াশোনা করেন।

গত ফেব্রুয়ারির শুরু থেকেই কেরালার বিমানবন্দরে স্ক্রিনিং ব্যবস্থা চালু হয়। করোনা আক্রান্ত নয়টি দেশ থেকে আসা যাত্রীদের বাধ্যতামূলকভাবে হোম কোয়ারেন্টিনে রাখা হয়। কোয়ারেন্টিনের ক্ষেত্রে কেরালা অত্যন্ত কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছিল। ওইসময় কেরালায় প্রবেশের পর কোয়ারেন্টিন শেষ হওয়ার আগেই অন্য রাজ্যে ঘুরতে যাওয়ার সময় অন্তত ১২জন পর্যটককে বিমানবন্দরে আটকানো হয়েছিল। বিদেশি যাত্রী ও অনাবাসিকদের জন্য সরকারি উদ্যোগে কোয়ারেন্টিনের ব্যবস্থা করা হয়।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনা অনুযায়ী ব্যাপক হারে পরীক্ষা করা ভারতের মতো একটি ঘনবসতিপূর্ণ দেশে প্রায় অসম্ভব মনে হলেও শক্তিশালী চিকিৎসা ব্যবস্থার কারণে কেরালা তা সম্ভব করে দেখিয়েছে। এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে কেরালায় ১৩ হাজার করোনা পরীক্ষা করা হয়েছে। এখন পর্যন্ত ভারতে সবচেয়ে বেশি পরীক্ষা হয়েছে এ রাজ্যটিতে। অথচ একইরকম জনসংখ্যা নিয়ে অন্ধ্রপ্রদেশে স্বাস্থ্য পরীক্ষা হয়েছে ৬ হাজার, অন্যদিকে প্রায় দ্বিগুণ বেশি জনসংখ্যার তামিল নাড়ুতে পরীক্ষা হয়েছে ৮ হাজার।

দুর্দান্ত চিকিৎসা ব্যবস্থা

প্রায় ৩০ বছরেরও বেশি সময় ধরে রাজ্যটিতে কমিউনিস্ট শাসন চলছে। কেরালায় সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগ করা হয় শিক্ষাখাত ও সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবায়। ভারতের মধ্যে সবচেয়ে ভালো জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থা আছে কেরালা রাজ্যেই। সাক্ষরতার হারও সবচেয়ে বেশি।

স্বাস্থ্যমন্ত্রী শৈলজা জানান, অন্তত ছয়টি রাজ্য কেরালার কাছে পরামর্শ চেয়েছে। কিন্তু, রাতারাতি কেরালার মতো ব্যবস্থাপনা অন্য রাজ্যে গড়ে তোলা কঠিন।

কেন্দ্রীয় সরকার লকডাউন ঘোষণার পর বিভিন্ন প্রদেশ হতবিহ্বল হয়ে পড়লেও আগে থেকেই প্রস্তুত ছিল কেরালা। মহামারি ঠেকাতে ২৬ কোটি ডলারের একটি প্যাকেজ ঘোষণা করেছে এখানকার সরকার। দুই মাসের অগ্রীম পেনশনের টাকা পরিশোধ, স্কুল শিক্ষার্থীদের বিনামূল্যে খাবার সরবরাহ ও শক্তিশালী ইন্টারনেট নেটওয়ার্কের জন্য পরিষেবা প্রদানকারীদের সহায়তাসহ নানা পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।

আক্রান্তদের মানসিক স্বাস্থ্যের দিকে নজর

কঠোর পদক্ষেপের পরও ফাঁক গলে বেরিয়ে গিয়েছেন ইতালি ফেরত এক দম্পতি। স্বাস্থ্য কর্মকর্তাদের কাছ থেকে তথ্য গোপন করেন তারা। করোনা শনাক্ত হওয়ার পর জানা যায়, তারা ইতালি থেকে ফিরেছেন। কোয়ারেন্টিনে না থাকার কারণে অনেক মানুষের সংস্পর্শেও এসেছেন। তাৎক্ষণিকভাবে তাদের সংস্পর্শে আসা প্রায় ৯০০ জনকে চিহ্নিত করে আইসোলেশনে নেওয়া হয়।

ওই দম্পতির জামাতা রবিন থমাস (৩৪) জানায়, তার পরিবারের সবাই করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। তিনি, তার স্ত্রী, স্ত্রীর বাবা-মা, এমনকি দাদা-দাদির দেহেও করোনা শনাক্ত হয়।

তিনি বলেন, ‘মানুষ আমাদেরকে ফেসবুক ও হোয়াটসঅ্যাপে বিভিন্ন ধরনের কুমন্তব্য করেছে, দোষারোপ করেছে। তাই সেসময় একজন মনোচিকিৎসক আমাদের সঙ্গে নিয়মিত ফোনে যোগাযোগ করেছেন। আমাদেরকে সান্ত্বনা দিয়েছেন, আত্মবিশ্বাস জুগিয়েছেন।’

দুর্দান্ত চিকিৎসাব্যবস্থার পাশাপাশি করোনায় সুস্থ হওয়া ব্যক্তিরা যাতে কোনো বৈষম্যের শিকার না হন, তারা যেন মানসিকভাবে ভেঙে না পড়েন সে ব্যবস্থাও নিয়েছে কেরালা সরকার।

থমাস জানান, তিনি ও তার স্ত্রী সুস্থ হয়ে উঠেছেন। কিছুদিন আগে দাদা (৯৩) ও দাদীও (৮৮) করোনা মুক্ত হয়ে হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফিরেছেন।

থমাস বলেন, ‘আমরা তাদেরকে নিয়ে খুব চিন্তিত ছিলাম। ভেবেছিলাম তারা হয়তো বাঁচবে না। দাদার এর আগে হার্ট অ্যাটাক হয়েছিল, তবুও ডাক্তাররা বলেছেন তারা তাদের সর্বোচ্চ চেষ্টা করবেন।’

স্বাস্থ্য পরীক্ষার নতুন পদ্ধতি চালু

সর্বাধিক দ্রুত শনাক্তকরণ কিট সংগ্রহ করে ভাইরাসের হটস্পটগুলোতে নিয়মিত পরীক্ষা চালাচ্ছে কেরালা কর্তৃপক্ষ। দক্ষিণ কোরিয়ার মডেলের আদলে এই সপ্তাহে কেরালায় চালু হয়েছে ওয়াক-ইন টেস্টং ব্যবস্থা। ওয়াক-ইন টেস্টিং ব্যবস্থায় স্বাস্থ্যকর্মীদের ব্যক্তিগত সুরক্ষা সরঞ্জাম গায়ে জড়িয়ে নমুনা সংগ্রহ করার প্রয়োজন পড়ে না।

স্বচ্ছ কাঁচের তৈরি বুথের ভেতর থেকে স্বাস্থ্যকর্মীরা বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা রোগীর কাছ থেকে নমুনা সংগ্রহ করবেন। তাই জরুরি মেডিকেল সামগ্রীর সংকটের সময়েও ব্যাপক হারে পরীক্ষা চালানো অব্যাহত থাকবে কেরালায়।

পাহাড়ের আলো

https://pahareralo.com

সর্বাধিক জনপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল। সর্বশেষ সংবাদ সবার আগে জানতে চোখ রাখুন পাহাড়ের আলোতে।

Related post