কোভিড vs বাস্তবতা- রুপা মল্লিক

                                                   রুপা মল্লিক রুপু
চারিদিকে অভিশপ্ত প্রকৃতি। ভয়ঙ্কর অদৃশ্য ভাইরাসে হারিয়ে যাচ্ছে অগণিত তাজা প্রাণ। যার ফলে লক ডাউন সারা দেশে। এমনি মুহুর্তে স্বপ্নের ঘর নির্মাণ সাময়িক ভাবে বন্ধ রাখলো রাজন ও অন্তরা দম্পত্তি। কারণ লক ডাউন মানে তো আয়ের উতসও বন্ধ। তাই বাড়িতেই সময় কাটাতে হয় বেশিরভাগ সময়। তারপরেও মানসিক প্রশান্তি নিতে মাঝে মাঝে বের হয় রাজন, কিন্তু বেশি দূর নয়, শুধু ঘর থেকে একটু অফিস পর্যন্ত। কখনো সকালে কিছুক্ষণ গিয়ে বসে, নয়তো বিকেলে। কারণ ভরসা আছে যে তাদের ভ্যাকসিন নেওয়া আছে, একটু বের হলে হয়তো তেমন কোন সমস্যাই হবেনা।
সেদিন ছিল ৩০ মে, শনিবার। দুপুরের পর অফিসে গিয়েছিল রাজন।শেষ বিকেলে অফিস থেকে বাড়ি ফিরল সে। চারিদিকে করোনা মহামারী আতঙ্ক, তাই বাড়ি ফিরেই বাথরুমে গিয়ে নিজেকে পরিস্কার করে নেয় সে। এরপর বিছানায় শুয়ে পরে । একটু পরেই স্ত্রী অন্তরা আসে এবং বলে, ‘কি হলো, আজ যে এসেই শুয়ে পরলে, শরীর খারাপ নাকি?’ জবাবে রাজন বললো,” হ্যাঁ, আজ শরীরটা ব্যাথা করছে, জর আসবে বোধহয়।“ অন্তরা লক্ষ্য করলো স্বামীর মুখখানা মলিন হয়ে আছে। কপালে হাত দিয়েই সে বুঝলো আসলেই তার প্রিয় মানুষ টার কপাল অনেক টাই গরম। সে বললো কিছু খেয়ে একটু বিশ্রাম নাও। কিন্তু রাজন মাথা নেড়ে জানালো এখন কিছু খাবেনা সে।
এদিকে বাবা পাগল ছেলে মেয়ে দুটোও বাবার ঘরে এল, কারণ বাবা ঘরে ফিরলেই আগে তাদের সাথে কথা বলতে হবে, করতে হবে দুস্টুমি, কিন্তু আজ যেহেতু বাবা এসে একটু মজা করেনি , তাদের কি আর ধরে রাখা যায়? ওরা, বাবা বলে ডাকতেই রাজন বললো, বাবা একটু বিশ্রাম নিই ,পরে একসাথে খাওয়া দাওয়া করবো, কেমন। এরপর ঘুমিয়ে পরলো রাজন। এরি মধ্যে রান্নার কাজ সেরে ফেলল অন্তরা। এরপর রাজনের কাছে এসে কপালে হাত দিতেই অন্তরার মন টা খারাপ হয়ে যায়, “একি ওর কপাল টা তো অনেক গরম ” অন্তরা তখন স্বামীকে ডেকে ঘুম থেকে জাগায় এবং তাকে গরম কিছু খেয়ে নিতে বলে। এরপর পরিবারের সবাই মিলে খাবার খেয়ে নেয় । খাবার শেষে রাজনকে একটি জরের ওষুধ খাইয়ে দেয় অন্তরা। রাতে সারারাত প্রচুর জর, সাথে শরীর ব্যাথা, থার্মোমিটারে মাত্রা ১০৩ ডিগ্রী। গা মোছা, কপালে রুমাল ভিজিয়ে পট্টি দেয়া এছাড়াও সার্বিক খেয়াল রাখা নিয়ে রাত কাটে অন্তরার।
এরপর সকালে ডাক্তারের সাথে কথা বলে সেইমত ওষুধ খাওয়ানো হয়, এভাবে পর পর দুদিন প্রচুর জর শেষে কিছুটা স্বস্তি আসে রাজনের। কিন্তু ০১ জুন দুপুর থেকে আবারো জর, কিন্তু এবার জর অন্তরার, বিকেল গড়াতেই ছোট ছেলেটার জর। বাকি ঘরের অন্য দুজন সদস্য, রাজনের ভাগ্নী আর মেয়ে। দুদিন মেডিসিন ও বিশ্রাম নেবার পর মা ছেলেও অনেকটা সুস্থ, কিন্তু এবার জর শুরু হলো মেয়ে আর ভাগ্নীর। ওদেরো ১০৩ ডিগ্রীর উপরে জর। কিন্তু সবাইকে সুস্থ রাখার প্রচেষ্টায় আছে অসুস্থ অন্তরা।
এভাবে তিন চারদিন কেটে গেল, সবার জর ও মোটামুটি কমে গেল। কিন্তু অন্তরা লক্ষ্য করলো রাজন কিছুক্ষণ পর পর কাশি দিচ্ছে । আবারো তার তাপমত্রা বেড়ে যাচ্ছে। খুব চিন্তিত হয়ে পড়লো অন্তরা। কারণ দুদিন যাবত স্বাভাবিকের চেয়ে একেবারেই কম খাচ্ছে রাজন। আর কেমন যেন দুর্বল হয়ে পরছে। স্বভাব খিটখিটে, এমনকি কারো সাথে ফোনেও কথা বলতে চাইছে না।
ঘরের সবাই অসুস্থ , তাই বলে বসে থাকলে তো চলবেনা , এই ভেবে ঘরের সবার খেয়াল রাখা, খাবার তৈরি, সকলকে খাওয়ানো, ঘর পরিস্কার করা, কাপড় ধোয়া থেকে শুরু করে সব দিকেই খেয়াল রাখছে অন্তরা। কিন্তু রাজনকে নিয়ে অনেক উদবিগ্ন সে, কারণ রাজন মোবাইল বন্ধ করে রেখেছে, কারো সাথে যোগাযোগ করছে না। আবার যারা কাছের মানুষ তারাও বার বার ফোন করে তার খবর নিচ্ছে অন্তরার কাছ থেকে। সবাইকে সব কিছু বলাও সম্ভব হচ্ছে না। কারণ ঘরের সবাই অসুস্থ, সবার যত্ন নেওয়া, অনেক ব্যাস্ততা।
রাজনের প্রতি তার যত্নের কোন শেষ নেই। কিন্তু তারপরেও রাজনের শারিরীক অবস্থার উন্নতি দেখতে পাচ্ছে না সে। অনেক ভেবে রাজনের প্রিয় বন্ধুদের মধ্যে নিয়মিত খোজ নিচ্ছিল বলে জীবন ও পার্থকে ফোন দেয় অন্তরা, পাশাপাশি ঘরের জন্য কিছু বাজার আনতেও বলে দেয় অন্তরা। কারণ সপ্তাহ খানেক তাদের বাসায় বাজার করা হয়না।আর অসুস্থ স্বামীকে ও সন্তানদের একা রেখে কোথাও যাওয়ার মত সুযোগ নেই । কিছুক্ষণ পর রাজনের বন্ধুরা ফোন পেয়ে আর দেরি করলো না। বাজার হাতে নিয়ে চলে এল রাজনকে দেখতে, ডাক্তারের কাছে নিতে চাইলে’ আর দুদিন দেখি,’ এমনটাই বলে রাজন। অথছ এই সিদ্ধান্তটাই ছিল রাজনের জন্য বড় একটা ভুলের। তবে বন্ধুদের পেয়ে মনটা অনেক বড় হয় রাজনের। কারণ গত ক’দিন যাবত পরিবারের সবাই অসুস্থ শুনে এ বাড়ির কাছেও ভিড়ছে না কেউ।
৭ জুন সকাল থেকে রাজনের কাশির অবস্থার আরো অবনতি হয়, অন্যদিকে কোন খাবার খেতে পারছে না সে। কিছু খেতে গেলেই বমি ভাব বা বমি হয়ে যাচ্ছে। আবার দুদিন যাবত নাকে কোন ঘ্রাণ বা জিহবায় কোন স্বাদ পাচ্ছেনা অন্তরা। এসবের কারণে সে নিজে থেকেই ভাবছে যে নিশ্চই মহামারী করোনার ছোবল পরেছে তাদের উপর। এবার মন শক্ত করে অন্তরা, সে ভাবে ‘আমি , আমার স্বামী ও আমার পরিবারের সবাইকে সুস্থ হতে হবে, আমি পারবো ইনশাল্লাহ’। অন্তরা রাজনকে নিয়ে ৭ তারিখ সোমবার সদর হাসপাতালে যায় এবং কোভিড টেস্টের জন্য দুজনি সিরিয়াল দেয়। বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষার পর তারা সেম্পল দেয়, সেম্পল দিয়েই অন্তরাকে টেস্ট কারী জানায় আপনার পজিটিভ। তার আগেই রাজন সেম্পল জমা দিয়েছিল কিন্তু ওর রিপোর্ট জানাতে একটু দেরি হওয়ায় অপেক্ষা করে তারা।
কিছুক্ষণ পর হাসপাতালের এক ছোট ভাই সাদ্দাম এসে জানায় আপু , স্যার ও আপনার দুজনেরি পজেটিভ। যে মানুষটা গত এক সপ্তাহ যাবত হাটা চলা করার শক্তি পাচ্ছিল না সেই মানুষটাই আজ প্রায় দেড় ঘন্টা অপেক্ষা করে এমন একটি খবর জানলো। ডাবল ডোজ ভ্যাকসিন সম্পন্ন করেও এমন অবস্থা! একমুহুর্তের জন্য তারা যেন স্তব্ধ হয়ে গেল। কিন্তু না, এভাবে বসে থাকলে তো চলবে না, নিজেকে সাহস দেয় অন্তরা, রাজনকেও সাহস দেয়। বলে, আল্লাহ ভরসা, তোমার কিছু হবে না ইনশাল্লাহ। এই বলে বাড়ির পথে পা বাড়ায় তারা। বাড়ি ফিরে সন্তানদের মলিন মুখের দিকে তাকায় তারা, ওরাও অপেক্ষা করছিল বাবা-মায়ের একটা ভাল সংবাদের জন্য। কিন্তু কথায় আছে ‘ভাগ্যের লিখন যায়না খন্ডন’। রিপোর্ট শুনে কাদপ্রায় সন্তানদের আশ্বাস দেয় অন্তরা ও রাজন। এরপর ঘরে ঢুকেই নিজেদের সম্পূর্ণ আলাদা করে ফেলে তারা। সন্তানদেরো তেমনি আলাদা কক্ষে রাখে। ডাক্তারকে অবস্থা জানিয়ে নতুন করে মেডিসিন খাওয়ানো শুরু হয় রাজনকে। মাহামুদ ভাইকে খবর দিলে তিনি এসে ওষুধ গুলো এনে দিয়ে যান।কারণ রাজনের শারিরীক অবস্থাই বেশি খারাপ হয়ে পরে।
কিন্তু এমন বিপদে পাশে নেই কেউ, কারণ করোনা আতঙ্ক সবাইকে দূরে সরিয়ে দিয়েছে। পাড়া প্রতিবেশি, বন্ধু বান্ধব সবাই কেমন যেন দূরে সরে গেছে। যারা সব সময় খবর নিত তারাও অচেনা হয়ে গেল। এই অবহেলা আরো কস্ট দিল তাদের। কারণ কোভিড রোগী কারো অনুগ্রহ চায়না, চায় শুধু একটু সহমর্মিতা।
তবে এত সব কিছুর ভিতরেও ভালোবাসার কিছু মানুষ আছে হাতে গোণা, যাদের কথা না বললেও নয়। অন্তরাদের কোভিডের খবর জেনেও সামিনা ভাবী প্রায়দিন বিকালে নাস্তা দিয়ে যেত বাচ্চাদের জন্য, রবিন ভাই বাসায় এসে দেখে যেত ,ুন্তরার ভাই সুজন চট্টগ্রাম থেকে প্রতিদিন খবর নিত,মুজাহিদ ভাই মাঝে মধ্যে প্রয়োজনীয় জিনিস নিয়ে আসতো, আর তার স্ত্রী নাহার ভাবীও বাচ্চাদের জন্য ডিম ,নাস্তা এনেছিল কয়েকবার। ঠিক পাশের বাসার রিতা ভাবী ও ভাই দুজনে ডেকে ডেকে খবর নিয়েছেন অনেকবার, পাঠিয়েছেন কাশি ভাল হবার জন্য তুলসি, বাসক সহ আরো কিছু জিনিস।আবার ভাগ্নী রাইসা ,মামার জন্য রান্না করে এনেছিল, তার মামাকে দেখে সেকি কান্না। কারণ সে তার মামার এমন করুণ চেহারা আগে কখনো দেখেনি, কিন্তু মামা তাকে বলে এই কয়দিন আর আসিও না মামা। ওদিকে রাইসার বাবা মানে বড় দুলাভাই নিজেও অসুস্থ ,তার পরেও শালা কে দেখতে দূর থেকে ছূটে আসে। নিষেধ করায় আসতে না পেরে ঘরে বসে কাদতে থাকে বড় আপা। সাংবাদিক আইমান ভাই – ভাবীকে নিয়ে দেখতে এসে রীতিমত অবাক হয়ে যান। মাহামুদ ভাই নিয়মিত ওষূধ সহ আরো কিছু লাগবে কি না সেই খবর রাখেন, রনিও কয়েকবার ওষুধ এবং ফল এনেছিল, রাজনকে দেখতে বাসায় এসেছিল রাহাতও। রণি, রাহাত আর মাহামুদ ভাই রাজনের অফিসের স্টাফ। এছাড়াও বিভিন্ন জায়গা থেকে আরো অনেকেই আসে যাদের কথা আসলে মন থেকে ভুলতে পারেনা অন্তরা। হাতে গোণা এই ক’জন মানুষের কাছে চিরঋনী সে।
কোভিড টেস্ট করে ফেরার পর রাজনের কাশি যেন আরো বেড়ে যায়। এদিকে বার বার ফোন করে শুভাকাঙ্খিরা দিচ্ছে বিভিন্ন পরামর্শ। বিশাল দাদা বার বার বলছেন এক্সরে করাতে, ওনার কোন রিলেটিভ নাকি এমন অবস্থা থেকে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়েছিল, তাই দেরি করতে বারণ করেন তিনি । কিন্তু রাজনকে তো কছুই বলা যায়না, এমনকি ফোনে কারো সাথে কথাও বলতে পারছে না সে। কি আর করা, তাই ডাক্তারের পরামর্শের বাইরে ইউটিউব দেখে নিজের প্রচেষ্ঠায় আরো অনেক কিছু করে যায় অন্তরা, কিন্তু রাজনের কাশি কোন ভাবেই কমে না। জরের পর ৮ম দিন পার হয়ে গেল, রাতে রাজন কাশতে কাশতে এক পর্যায়ে তার কোমড়ে প্রচন্ড ব্যাথা শুরু হলো, আবারো ডাক্তারের সাথে কথা বললো অন্তরা, ডাক্তার জানালো কি করতে হবে। সারারাত খুব যন্ত্রনার মধ্য দিয়ে কাটালো তারা। ইতিমধ্যে নবম দিনে আরো বেশি চিন্তিত অন্তরা। কারণ আজো রাজনের কাশির মাত্রা অপরিবর্তনীয়। ইউটিউবে বিভিন্ন ডাক্তারের পরামর্শে অন্তরা জানতে পারলো ৭ম, ৮ম ও ৯ম দিনগুলোতে আবার জর হতে পারে, শরীরের অবস্থা আরো খারাপ হতে পারে।
তাই রাজনের অবস্থা দেখে নিজের সাহস হারানোর অবস্থা অন্তরার। রাজনের শরীর একেবারে শুকিয়ে গেছে, চোখ দুটো কেমন যেন নিস্প্রাণ হয়ে গেছে ।তাই অন্তরা ভেবে পাচ্ছে না কি করা উচিত। এক পর্যায়ে সে ফোন করলো আরেক জন ডাক্তারকে, যার কোভিড চিকিতসা সম্পর্কে অনেকের কাছেই জেনেছে সে। অন্তরা ফোনে সব কিছু জানালো ডাক্তার সাহেব কে। আর ডাক্তার পরামর্শ দিলেন শীঘ্রই এক্সরে করার। রাজনকে জানাতেই সে বললো আরো দু একদিন দেখি, আমার যেই কাশির অবস্থা, বাইরে কি করে যাব? আমার কাশি দেখলে মানুষি বা কি বলবে? কিন্তু এই কথা গুলো সহ্য করতে পারেনা অন্তরা, কারণ সে দেখতে পাচ্ছে যে তার প্রিয় মানুষটা কিভাবে ধীরে ধীরে দুর্বল হয়ে পড়ছে। তাই সে অনেকটা জোড় করে রাজনকে। তবে রাজন জানায় প্লিজ অন্তত দুটো দিন দেখি। আসলে একজন করোনা রোগী শুধু শারিরীক ভাবে নয়, মানসিক ভাবেও অনেক ক্ষতিগ্রস্ত হয়, যার ফলে তাদের আচরণ অনেক খিটখটে ও রুক্ষ হয়ে থাকে। রাজনের ক্ষেত্রেও ঠিক তেমনি হয়েছে।
এমনিভাবে আরো বিভীষিকাময় দুটি রাত পার করতে হলো অন্তরাকে, যে রাত গুলো পার করতে অন্তরার যেন দুটি বছর কেটে গেল। এই দু দিন রাজনের জীবনে যেন অন্ধকারের কালো ছায়া নেমে আসতে গিয়েও আসতে পারেনি। হয়তো মহান আল্লাহ এমনটাই চেয়েছেন । অনেক ভেবে এবার অন্তরা – রাজনের বন্ধু আলমকে কে বাসায় আসতে বলে। তিনিও আসতে রাজি হয়ে যান এবং সাথে তার আরেক বন্ধু মালেক কে নিয়ে আসেন। আলম ভাই এসে বন্ধুকে দেখে অবাক, বলেন “ রাজন, তোর শরীর তো অনেক খারাপ হয়ে গেছে, চল ডাক্তারের কাছে”। এবার রাজনও সম্মতি জানালো, কিন্তু দুর্ভাগ্য সেদিন ডাক্তার সাহেব বিশেষ প্রয়োজনে বাড়ি গেছেন। ফোন করে জানা গেল তিনি পরদিন শনিবার ফিরবেন এবং দুপুরে রাজনকে দেখাতেও বললেন।
অবশেষে অনেক যুদ্ধের পর স্বস্তি পেল অন্তরা , তার স্বামীকে এবার ভালো ট্রিট্মেন্ট দেয়া যাবে বলে। কিন্তু সেদিন রাতে রাজনের শারিরীক অবস্থা আরো খারাপ হয়ে যায়। কাশির জন্য সে সারা রাত ঘুমাতে পারে না। অন্তরা তার সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যায় স্বামীর চোখে একটু ঘুম আনাতে। অবশেষে রাত তিনটার দিকে একটু ঘুমায় রাজন। যদিও বিগত এক সপ্তাহ এমনটাই হয়ে আসছিল। কিন্তু আজকের রাতটা্ই যেন বেশি কষ্টের ও আতঙ্কের। যেন কালবৈশাখী ঝড়ের তান্ডবে জর্জরিত রাতটি। এমন সব আতংক নিয়েই আবার ভোর সাড়ে ৫ টার দিকে কাশির জন্য ঘুম ভাঙে রাজনের। তখনো তার পাশে দিব্যি বসে আছে অন্তরা। তবুও দিনের আলো দেখে কিছুটা স্বস্তি আসে অন্তরার মনে।
আজ স্বামীকে ডাক্তারের কাছে নিবে ভেবে তারাতারি রান্না সহ অন্য সকল কাজ সেড়ে নেয় অন্তরা। সাথে মেয়ে আর ভাগ্নীও আজ যথেষ্ঠ সাহায্য করে তাকে। গত ০৮ দিনের মত রাজন একদিনও ভাত খায়নি। দুমুঠো কালিজিরা চালের জাউ ভাত রান্না করলে তিন বেলা খেয়েও আরো থেকে যেত। আজও তেমনি এক চামচ জাউ ভাত খেয়ে নেয় রাজন , তাও আবার অনেক কষ্টে। এরপর নিজ থেকেই প্রস্তুত হয়ে নেয় সে, অন্তরাও গোসল সেড়ে কাপড় গুলো ভিজিয়ে রাখে, কিন্তু রাজনের ডাক্তারের কাছে যেতে দেরি হয়ে যাচ্ছে বলে সেগুলো না ধুয়েই সে নিজেও রেডি হয়ে নেয়। বাচ্চাদের বলে যে, তোমরা দোয়া কর যেন, ডাক্তার তোমার বাবাকে দেখে একটা ভাল রিপোর্ট দেয়। কিন্তু যা পেল তার জন্য ওরা কেউ তৈরি ছিলনা।
মেডিকেল সেন্টার তাদের বাড়ি থেকে বেশি দূরে নয়। ৫-৭ মিনিটের মধ্যেই তারা সেখানে পৌছে গেল। কাশির কারণে ভেতরে যেতে চাইছিল না রাজন। তবুও সিরিয়াল পেয়ে তারা ডাক্তারের চেম্বারে প্রবেশ করল। রাজনের মুখ দেখেই ডাক্তার সাহেব বললেন, আপনাকে তো আরো সপ্তাহ খানেক আগে আসতে বলেছি, এত দেরি করলেন কেন? আপনি অনেক দেরি করে ফেলেছেন, আমি সেদিন আপনারা আসবেন বলে অপেক্ষা করছিলাম। এরপর ইমার্জেন্সি একটা এক্সরে করতে বলেন ডাক্তার সাহেব। জরুরি ভিত্তিতে এক্সরে সম্পন্ন করা হয় সেখানেই। এক্সরে করার পর কাশির যন্ত্রনায় টিকতে না পেরে আবার বাইরে গিয়ে অপেক্ষা করে রাজন।
এরি মধ্যে সেখানে উপস্থিত হন বন্ধু আলম। রাজনের রিপোর্টও রেডি। রিপোর্ট ডাক্তার সাহেবকে দেখানোর পর তিনি অবাক হয়ে যান এবং অন্তরাকে উদ্দেশ্য করে বলেন, আপনারা কেন এত দেরি করেছেন? ওনাকে সেদিন আনলে হয়তো অবস্থা এত বেশি খারাপ হতোনা। এখনি ওনাকে সদর হাসপাতালে ভর্তি করে দিন। একথা শোনার পর অন্তরার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো। আলম ভাই সাহস দিলেন, বললেন ভাবী আল্লাহ ভরসা, এত টেনশান নিয়েন না। তখন ডাক্তার বললেন যে, দেখেন আমার বাবাও( ডাক্তারের বাবা) কিছুদিন আগে খুব বেশি অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন, ওনার অক্সিজেন লেবেল ছিল ৮০%, আর ওনার ট্রিটমেন্টও আমি করেছি। আলহামদুলিল্লাহ তিনি অনেক ভাল আছেন। সেদিক থেকে রাজন ভাইয়ের অক্সিজেন লেভেল অনেক ভালো আছে, ৯২/৯৩/৯৪%। আপনি ওনাকে এখনি হাসপাতাল নিয়ে যান, ইনশাল্লাহ আমিই ট্রিটমেন্ট চালাবো। আমি চিকিতসার সব লিখে দিচ্ছি, আর পারলে একটা কেবিন ঠিক করান। সাথে আলম ভাই ছিলেন, আরো বাইরে রাজনকে দেখে খাইরুল ভাই নিজেও ভেতরে চলে আসেন রাজনের অবস্থা জানতে। হাসপাতাল নিতে হবে জেনে তিনি নিজেই ফোন দিয়ে একটি কেবিনের কথা বলে রাখেন।
ডাক্তারের প্রেসক্রিপশান হাতে পেয়ে আলম ভাই সহ অন্তরা –রাজনকে নিয়ে গেল হাসপাতালে। হতভম্ব রাজন উদাস দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল ,এদিকে তখনো সে কাশছিল অনেক। হাসপাতাল পৌছেই রাজনকে একপাশে রেখে জরুরি বিভাগ থেকে ভর্তির সব কিছু রেডি করছিল অন্তরা আর আলম। এরি মাঝে অন্তরা কল দিয়ে আসতে বলে রবিন ভাইকে , আর বড় আপাকে ফোন দিয়ে জানায় সব এবং বাসায় আসতে বলে । কারণ বাসায় যে তাদের কলিজার টুকরো দুটোকে রেখে এসেছে। অন্তরা বার বার লক্ষ করছিল প্রিয় মানুষটার দিকে। রাজনকে দেখে বোঝা যাচ্ছিল সে খুব কষ্ট পাচ্ছে, চেহারাটা কেমন যেন ফ্যাকাশে হয়ে গেছে, অনেক শুকিয়ে গেছে সে। মনে হচ্ছিল লম্বা একটা হাড়ের উপর চমড়া বসানো শুকনো ও রুগনো একটা মানুষ দাঁড়িয়ে। কান্নায় বুক ফেটে যাচ্ছিল্ অন্তরার, কিন্তু মুখে কান্নার রেশমাত্র নেই। অবশেষে ভর্তি করে কেবিন রুমে নেওয়া হয় রাজনকে। সাথে ছিল অন্তরা , আলম ভাই আর রবিন ভাই। সেখানে গিয়েই শুয়ে পড়ে রাজন, কারণ দুপুর ২ টার পর থেকে এই বিকেল ৪.৩০ একবারো সে একটু বিশ্রাম নিতে পারেনি, শরীর কেমন যেন নরম ও আরো দুর্বল লাগছিল তার। এমন সময় নার্স এসে অক্সিজেন পড়িয়ে দেয় রাজনকে। অন্তরাকে শিখিয়ে দেন ব্যাবহারের নিয়ম এবং একটি কাগজ দিয়ে বলেন যে ‘ এই মেডিসিন গুলো এক্ষুণি লাগবে’।
হাতে থাকা তিন হাজার টাকা রবিন ভাইয়ের হাতে দিয়ে কাগজে লিখা মেডিসিন গুলো আনতে বলে অন্তরা। রবিন কিছুক্ষণের মধ্যেই ওষুধ নিয়ে এসে অন্তরার হাতে ওষুধের হিসাব টি দেয় এবং বলে অনেক টাকা লাগবে, টাকা যা লাগবে বল আমি ব্যাবস্থা করছি। অন্তরা দেখে ওষুধের হিসাবে লেখা বাকি ১৯,০০০ আর জমা ৩০০০। যাই হোক চিকিতসা শুরু হয় রাজনের। নার্স এসে ক্যানোলা লাগিয়ে ইনজেকশান ও স্যালাইন দেয় এবং নাভির পাশে একটা ইঞ্জেকশান দেয়। ইতিমধ্যে বড় আপাও বাসায় না গিয়ে আগে ভাইকে দেখতে হাসপাতাল চলে আসে। ভাইয়ের মলিন মুখখানা দেখে কান্নায় ভেঙে পরেন তিনি। অন্তরা-বড় আপাকে শান্তনা দিয়ে বাড়িতে পাঠান এবং বলেন তার ভাইয়ের জন্য কিছু কাপড় গুছিয়ে রাখতে, কিছুক্ষণ পর আমিও আসছি।
আলম ভাই জরুরি কাজে বাড়ি ফিরেন । ইতিমধ্যে অনেকেই জেনে যায় রাজনের হাসপাতাল এডমিট হবার বিষয় টা। কিছুক্ষণের মধ্যেই চলে আসেন জীবন, খান সাহেব, কাদের, মাসুম সহ আরো অনেকে। ছোট ভাই রাসেল কে পানি আনতে বলে রবিন। ও আসলে তাদের সবাইকে হাসপাতাল রেখে রবিন ভাইকে নিয়ে ঘরে ফিরে যায় অন্তরা। বাসায় পৌছেই ছেলে মেয়ে দুটোর মুখের দিকে তাকিয়ে কেদে ফেলে অন্তরা, এবার আর নিজেকে ধরে রাখতে পারেনা সে। ছোট ছেলেটা তখনো কিছু জানে না, সে তার মাকে জিজ্ঞেস করে, ‘ মা তুমি একা আসছো কেন, আমার বাবা কোথায়?’ কিন্তু ছেলের প্রশ্নের জবাবে কি বলবে জানে না অন্তরা। তখন রবিন ভাই নিজের মত করে ছেলেটাকে বুঝিয়ে দেয়।
এদিকে গ্রামের বাড়ীতে অবস্থান রত রাজনের মা ও বোনেরা ফোন দিয়ে কান্না শুরু করে। মা বার বার বলেন ওনার একমাত্র ছেলেকে দেখতে উনি ছুটে আসবেন। কিন্তু লক ডাউন আর করোনার ভয়ে মাকে আসতে বারণ করা হয়। অন্তরা শাশুড়ি মাকে জানায় যে, হাসপাতাল পৌছেই সে রাজনের সাথে মায়ের কথা বলিয়ে দেবে। এরপর দুপুরের সেই ভেজা কাপড় গুলো ধুয়ে শুকাতে দিয়ে আবার রাতের জন্য খাবার রেডি করে নেয়অন্তরা। রাজনের জন্য কিছু পোশাক , কাথা, বালিশ, গ্লাস, প্লেট ইত্যাদি প্রয়োজনীয় কিছু জিনিস নিয়ে ছেলেমেয়ে, ভাগ্নী, বড় আপা সবাইকে ঘরে রেখে আবার হাসপাতালের পথে রওনা দেয় অন্তরা। যাবার সময় ৬ বছরের ছোট ছেলেটা বলে, ‘ মা- কালকে আমার বাবাকে নিয়ে আসবা? উত্তরে অন্তরা বলে তুমি দোয়া কর, ইনশাল্লাহ তোমার বাবা আসবে। এরপর হাসপাতাল ফেরার পথে ওষুধের ফার্মেসীতে যায় অন্তরা, যেখান থেকে রবিন ওষুধ গুলো নিয়েছিল। ফার্মেসীর মালিক ভৌমিক দাদাকে অন্তরা বলে, ‘দাদা, আপাতত ওষুধ গুলো আমি নিজে না এসে কাউকে পাঠালে দিয়ে দিবেন প্লিজ, টাকা পয়সা আমি দেব।‘ জবাবে ভৌমিক দাদা জানালেন, ‘আপনি নিশ্চিন্তে থাকেন, টাকা নিয়ে সমস্যা নাই,যা লাগে এখান থেকে নিবেন, আগে ভাই সুস্থ হোক।‘ ওনার উদারতায় অনেক আশ্বস্থ হয় অন্তরা, এরপর আবার হাসপাতালের দিকে রওনা দেয় সে।
হাসপাতাল পৌছে অন্তরা দেখে সবাই বাইরে বসে আ্ছে, ভেতরে শুয়ে আছে রাজন। অন্তরা ভেতরে ঢুকতেই রাজন বলে উঠে আমার সন্তানেরা কি করে? ওরা কাদছে নাতো। তুমি ওদেরকে কার কাছে রেখে এসেছো? কথা বলা শেষ না হতেই আবার কাশি শুরুহয় রাজনের। অন্তরা সব বুঝিয়ে বলে, এও বলে যে তুমি কোন কিছু নিয়ে চিন্তা করবে না। আমি সব ম্যানেজ করবো। এরমধ্যে যারা অনেক্ষণ অপেক্ষা করছিল তারা বললো যে আমরা কাছা কাছি আছি , যেকোন প্রয়োজনে আমাদের কল করবেন, আমরা চলে আসবো। কিছুক্ষণ পর রবিন ভাই এসে ২০০০০ টাকা অন্তরার হাতে দিয়ে বলে এগুলা রাখ, আরো লাগলে বলবি। এরপর রবিন ভাইও চলে যান। এবার শুধু তারা দুজন অন্তরা ও রাজন। রাজনকে অন্তরা বলে ‘তোমার এখন কেমন লাগছে?’ জবাবে রাজন বলে ’আলহামদুলিল্লাহ ভালো, আরো আগেই ডাক্তার দেখানোর দরকার ছিল, । একথা শুনে হু হু করে কেদে উঠে অন্তরা, তার স্বামী বুঝতে পেরেছে, কিন্তু অনেক দেরিতে। অন্তরার কান্না দেখে রাজন বলে কেদোনা, শুধু আল্লাহ কে ডাক। রাজন আরো বলে এতদিন কারো ফোন রিসিভ করা হয়নি, আজ সবার ফোন রিসিভ করবে। আমাকে যারা ভালোবাসে সবাই ফোন দেবে।
এরপর অন্তরা জানায় মা কথা বলতে চেয়েছে, কিন্তু রাজনের কথা বলার মত অবস্থা নেয়, গত ১০-১১ দিন সে একবারো কারো ফোন ধরেনি। কিন্তু মায়ের সাথে তো কথা বলতেই হবে, তাই মাকে ফোন দিয়ে কথা বলে রাজন। মা কাদছেন শুনে রাজন মাকে সাহস দেয়, আপনি শুধু দোয়া করেন মা। কথা শেষ করে আবার কাশি শুরু হয় তার। এভাবে দেখতে দেখতে স্যালাইন শেষ হয় । রাত ১০ টার দিকে আবার স্যালাইন দেওয়া , দেওয়া হয় নাভিতে ইঞ্জেকশান। রাজনকে রাতের খাবার হিসেবে এক চামচ জাউ ভাত আর এক টুকরো আপেল খাইয়ে দেয় অন্তরা। যদিও জোড় করেই খাওয়াতে হয়। এরপর ওষুধ খাইয়ে দেয় সে। ঘুমানোর অনেক চেষ্টা করে রাজন কিন্তু কোন ভাবেই ঘুমাতে পারেনা সে। করোনা ভাইরাসের আক্রমণ যে কতোটা ভয়াবহ তা কেউ বুঝতে পারবে না যদি নিজের চোখে না দেখে।
একটু ঘুম, একটু জেগে থাকা এমন সব যন্ত্রনা সাথে নিয়েই হাসপাতালে তাদের প্রথম রাত পার হয়। গরম পানিতে হাত মুখ ধুইয়ে ফ্লাক্সে রাখা গরম চা আর একটা বিস্কুট খাওয়ায় রাজনকে। প্রায় ৭ টা বাজতেই নার্স আসেন এবং আবারো রাজনকে স্যালাইন ও ইঞ্জেকশান দেন। যাবার আগে অন্তরাকে বলেন, ‘আপনাদের কি অক্সিমিটার আছে?, জবাবে সে বলে ‘ না , নেই’। নার্স বলেন যে আমদের স্যারের কাছে থাকতে পারে, একবার বলে দেখবেন, কারন এক ঘন্টা পর পর আপনারাও চেক করে অবস্থা দেখে নিতে পারেন বলে, তিনি চলে যান। এরপর অন্তরা বলে এবার দেখ একটু ঘুম আসে কিনা, কারণ রাতে ঘুমাতে পারেনি সে। অন্তরা আরো বলে, আমি বাসা থেকে নাস্তা রেডি করে আনি। রাজন বলে ঠিক আছে তুমি যাও, আমি থাকতেপারবো। রাজনের মনে যথার্থ সাহস দেখে সাহস পায় অন্তরা, বলে মোবাইল কাছে রাখ, আমি যাই। প্রয়োজনে ফোন দিবে। এতটা অসুস্থ মানুষটাকে যদিও একা রেখে যাওয়া উচিত নয় কিন্তু করারও তো কিছু নেই।
অন্তরাদের বাড়ি থেকে হাসপাতালে হেটে যেতে ৫-৬ মিনিট সময় লাগে । তাই গাড়ি না পেলেও হেটেই যেতে পারতো অন্তরা। বাসায় ফিরে দেখে ছোট ছেলেটা ঘুমাচ্ছে , আর মেয়েটা বসে আছে। ওরা মাকে দেখতেই লাফিয়ে উঠে বলে ‘ মা- বাবা কেমন আছে ,আর কয়দিন থাকবে? অন্তরা বলে আরো কয়েকদিন লাগবে। নিজে ফ্রেশ হয়ে নেয় সে , এরপর বড় আপাকে দেখে সে , আপার মুখখানাও কেমন যেন মলিন লাগছে। আপা জানায় গত পুরো রাত নাকি আপার অনেক জর ছিল। ভাগ্নী বলে মামী মাকে রাতে নাপা খাইয়ে দিয়েছিলাম। আবার চিন্তায় পরে অন্তরা, কারণ আপার বয়স হয়েছে ওনার করোনা হলে অনেক কষ্ট পাবেন তিনি। এরপর তারাতারি নাস্তা বানিয়ে ঘরে সবাইকে খাইয়ে দেয় সে । ছোট ছেলেটাকে আদর করে, আর ওদেরকে ভিডিও কলে বাবাকে দেখায় অন্তরা। ওরা তো বাবাকে দেখতে পেয়ে অনেক খুশি। আবার সবাইকে বিদায় জানিয়ে হাসপাতালের উদ্দ্যেশে রওনা দেয় সে।
যাবার পথে এলাকার কোন মানুষ কে দেখা গেল না, সবাই হয়তো এখনো ঘুমাচ্ছে। কিন্তু তখন সকাল সাড়ে আটটা। যাই হোক অন্তরা হাসপাতাল পৌছে যায়, অনেক কষ্টে তিন তলায় উঠে কেবিন রুমে যায় সে। তার যেন আর পা চলে না। কি করবে নিজেও তো কোভিড আক্রান্ত। কিন্তু স্বামীকে বুঝতে দেয় না নিজের কষ্ট। রুমে ঢুকেই হাত ধুয়ে রাজনকে একটু করে নাস্তা খাওয়ায়। আবার ওষুধ খাওয়ায়। রাজন জানতে চায় বাচ্চারা কি করছে, মেয়ে আর ভাগ্নীর কাশ আছে কিনা, কারণ ওরাও তো অসুস্থ। অন্তরা জানায় ওদের কাশি আছে আর বড় আপার জর উঠেছে। রাজন বলে তুমি কষ্ট করে তোমার, মেয়ের আর ভাগ্নীরও এক্সরে করাও। আর আপাকেও ডাক্তার দেখাও। আর কাউকে অবহেলা করা যাবেনা। অন্তরা বলে, তুমি ভেবোনা আমি দেখছি কি করা যায়।
কিছুক্ষণের মধ্যেই ডাক্তার সাহেব আসেন, মাথায় হাত দিয়ে বলেন আপনার এখন কেমন লাগছে, জবাবে রাজন জানায় আলহামদুলিল্লাহ ভালো লাগছে স্যার। ডাক্তার রাজনের অক্সিজেন লেভেল চেক করেন এবং বলেন যে অক্সিজেন মাস্ক বেশিরভাগ সময় দিয়ে রাখবেন। আর যেকোন প্রয়োজনে আমাকে ফোন করতে পারেন। কিছুক্ষণ পর ডাক্তার সাহেব চলে যান। এভাবে সকাল গরিয়ে যায়, অনেকেই ফোন করে খবর নেয়, কেউ কেউ দেখতে আসে। সবার হাতে ফল, এত ফল আসে যে রাখার জায়গা হয়না। সকাল ১১.৩০ এর দিকে বন্ধু আলম আসে। তাকে রেখে অন্তরা আবার বাসায় যায়, তার যে রান্না করা , বাসার বাকি সদস্যদের ডাক্তার দেখানো অনেক কাজ। বাসায় আসতেও অন্তরা লক্ষ করে এলাকার কাউকে দেখা যাচ্ছে না, সে অবাক হয়। এরপর ঘরে গিয়ে ফ্রেশ হএ রান্নার কাজে লেগে যায় সে। বড় আপার অনেক জর, মেয়েরাও কেমন দুর্বল হয়ে যাছে, তাই দুপুরের পর সবাইকে ডাক্তার দেখানোর সিদ্ধান্ত নেয় সে।
দুপুরের রান্না শেষে সবাইকে খাইয়ে আবার হাসপ[তাল যায় অন্তরা। যাবার পথে দু এক জন প্রতিবেশি কে দেখলেও কেউ জানতে চায়না রাজনের কথা। অন্তরা ভাবে যে মানুষটা সমাজের সবার বিপদে সকলের আগে গিয়ে দাঁড়ায় , আজ সে মানুষটার এমন বিপদে তার অবস্থার খবরও কেঊ নিচ্ছে না। ভাবতে ভাবতে হাসপাতাল পৌছায় অন্তরা। সেখানে গিয়ে দেখে আরো অনেকেই এসেছিল, এনেছিল অনেক ফল। অন্তরা রাজনকে বলে একটু করে খাবে আজ? কতদিন তুমি ভাত মুখে নেওনা। রাজন বলে একটুর বেশি দিওনা, আমার যে খাবারের কোন রুচি নেই, তুমি বাসায় গেছ আর ওরা দু ‘একটা ফল খাইয়েছেতো। অন্তরা বলে, তোমাকে খাইয়ে আবার মেয়েদের নিয়ে ডাক্তারের কাছে যাব। ওদের এক্সরে করাবো। ডাক্তারকেও বলেছি। রাজন বলে আল্লাহ ভরসা, তুমি ওদেরকে ভাল ভাবে দেখিয়ে এসো, আমার চিন্তা করবে না, নার্সরা বার বার এসে দেখে যায়, মেডিসিন দিয়ে যায়। এরপর একটু খাবার খাইয়ে , ওষুধ খাইয়ে রাজনকে ঘুমাতে দিয়ে আবারো ঘরে ফিরে অন্তরা।
বাসায় ফিরার আগেই মেয়েদের প্রস্তুত হয়ে থাকতে বলে সে। বড় আপা বলে দুপুরে তো আর জর আসেনি, আমি আজ থাকি, তুমি ওদের নিয়ে যাও। এরপর ছেলেকে আপার কাছে রেখে মেয়ে ও ভাগ্নীকে নিয়ে মেডিকেলে যায় অন্তরা। সেখানে গিয়ে অন্তরা সিরিয়াল নিয়ে ডাক্তার সাহেবকে দেখায়। ডাক্তার বলেন সবারি এক্সরে করিয়ে নিতে। তাই করে অন্তরা। এক্সরে রিপোর্ট আসার পর ওরা তিনজন একসাথে আবার চেম্বারে প্রবেশ করে। ডাক্তার সবার রিপোর্ট দেখেন এবং সবার অবস্থা বুঝে প্রেস্ক্রাইব করেন। ডাক্তারকে অন্তরা একটা অক্সিমিটারের কথা বলে, তিনিও একটা আছে বলে জানান। অন্তরাকে তিনি জানান আগামীদিন হাসপাতালে ভিজিট করতে আসলে নিয়ে আসবেন।
এরপর মেয়েদের নিয়ে বাড়ি ফিরে অন্তরা। ছেলেটা মায়ের জন্য অপেক্ষা করছিল। পরে মাকে দেখে অনেক খুশি হয় সে। আপা জানায় বোন, মা কাউকে না দেখে ও নাকি অস্থির হয়ে পরে। এবার সবার সাথে কথা বলে আবার হাসপাতাল যায় অন্তরা। অনেকেই এসেছিল ততক্ষণে। অন্তরার অনুপস্থিতে খুব একটা একা থাকতে হয়না রাজনকে। হাসপাতালে অনেকেই দেখতে আসে তাকে। এতদিন ঘরে কেউ আসেনি ঠিক কিন্তু হাসপাতাল আসার পর অনেকেই দেখতে আসছে। তারপরেও চিন্তার শেষ নেই অন্তরার। কারন সবাই থাকলেও ওর মত করে তো আর কেউ বুঝবে না। তবুও ডাক্তার ও নার্সদের আন্তরিকতা ও সেবার কোন কমতি নেই। ছোট একটি পার্বত্য জেলা হলেও চিকিতসা সংশ্লিষ্ঠ সকলেই অসাধারণ। সন্ধ্যার পর আবার বাসায় যায় অন্তরা , রাতের খাবার তৈরি করতে। আবার ফিরে আসে হাসপাতালে।
হাসপাতালের ২য় দিন রাতে মোটামুটি ভালই ঘুমায় রাজন। পরদিন সকালে আবার একই কাজ। রাজনকে ইনজেকশান ও স্যালাইন দেওয়া হলে বাসায় যায় অন্তরা, নাস্তা তৈরি করে ফিরে আসে হাসপাতালে। এদিকে অন্তরা পড়লো চিন্তায়, কারণ একটা ইঞ্জেকশন কোন ফার্মেসীতেই নাই। পরদিন লাগবেই, অর্ডার দিয়ে আনতে হবে চট্টগ্রাম থেকে। রবিন ও মাহামুদ মিলে ফার্মেসীতে কথা বলে ওষুধ অর্ডার করে। রাতের ভিতরে আসবে বলা হয়। দুপুরের খাবার তৈরির জন্য আবার বাসায় যায় অন্তরা,সেদিন আবার বড় আপাকেও ডাক্তার দেখায় সে, আপার এক্সরের রিপোর্ট দেখে ডাক্তার বলেন ওনারও সাসপেকটেড কোভিড ১৯ হয়েছে, আর সেইমত ওষুধ দেয় ডাক্তার। এবার আপাকে নিয়েও টেনশান , কারণ ওনারও যথেষ্ঠ যত্নের প্রয়োজন, তবে ভাগ্নীকে সব বুঝিয়ে দেয় সে। এরপর আবার হাসপাতালে ছুটে অন্তরা, যাবার পথে সে দেখে একজন প্রতিবেশি তাকে দেখে দৌড়ে লুকিয়ে যায়, আবার সে এগিয়ে গিয়ে হঠাত পেছনে ফিরে দেখে যে সেই মানুষটি আবার বের হয়ে দেখছে যে অন্তরা তাকে দেখে কিনা। এমন অবস্থা দেখে অন্তরার অনেক কষ্ট আসে মনে, কারণ সে বুঝতে পারলো যে , কেন আসা যাওয়ার পথে সে কাউকে দেখেনা।
হাসপাতালের সিড়ি বেয়ে উপরে উঠতে উঠতে অন্তরার চোখে সেই মানুষটির চুপি চুপি লুকিয়ে যাওয়া , আবার গোপনে দেখা এই ছবিটায় ভাসছে, সে মনে মনে আরো ভেঙে যাচ্ছিল। কেন মানুষ একজন কোভিড রোগীকে এত অবহেলা করে, কোভিড আক্রান্ত হয়ে কি কেউ অপরাধ করে ফেলে? এমন অনেক প্রশ্ন আসে তার মনে। এরপর রাজনের কক্ষে পৌছে সে দেখে রাজন ঘুমাচ্ছে। অন্তরা স্তব্ধ হয়ে বসে থাকে কিছুক্ষণ। রাজন জাগলে তাকে গোসল সেড়ে একটু খাইয়ে দেয় সে। একটু পরেই আলম ভাই তার স্ত্রীকে নিয়ে আসে। ভাবী রাজনের অক্সিজেন দেওয়া চেহারা দেখে কাদতে থাকে, স্ত্রীর কান্না দেখে আলম ভাইয়েরও চোখ টলমল করে। কিছুক্ষণ থেকে ওনারা চলে যায়। সন্ধ্যায় রাজনকে দেখতে আসে পার্থ ও প্রশান্ত। পার্থ ভাই তার প্রিয় বন্ধুবর রাজনের চেহারা দেখে রুমের বাইরে গিয়ে কেদে ফেলে, বারবার বলে আমার ভাইয়ের এত চমতকার চেহারা, বডি কিছুই নেই, কেমন হয়ে গেছেন তিনি। নিজেকে শক্ত রেখে অন্তরা বলে দোয়া করেন ভাই, আপনাদের সবার দোয়ায় সে ইনশাল্লাহ সুস্থ হয়ে যাবে।
আবার রাতের খাবার তৈরির সময় হয় অন্তরার। এবার রাজন বলে আমার আজ ভাত খেতে ইচ্ছে করছে, বাসায় কি বাজার আছে, কি রান্না করবে আজ? প্রায় ১৩ দিন পর আজ নিজের মুখে ভাত খেতে চাইল রাজন। অন্তরা অবাক হয়ে বলল, তুমি সত্যি আজ খাবে, কি খেতে ইচ্ছে করে বল। রাজন জানায় তার পছন্দের কথা, আবার নিজে থেকেই ফোন করে বন্ধু জীবনকে, বলে বাসায় একটু বাজার দিয়ে আসতে। জীবনও আজ রাজনের কিছু খাওয়ার ইচ্ছে শুনে খুব তারাতারি বাজার করে তাদের বাসায় রেখে এরপর রাজনকে দেখতে আসে। কিছুক্ষণ থেকে চলে যায় জীবন। এদিকে চট্টগ্রাম থেকে ঐ ইঞ্জেকশানটা রাত ১১ টায় আসবে বলে জানায় মাহামুদ। এর পর সে বাসায় যায়, খুব মন দিয়ে আজ অনেকদিন পর রান্না করে সে, কারণ আজ যে রাজন খাবে, ছেলে –মেয়ে সহ ঘরের সবাই খুশি এটা জেনে। তারপর ঘরের সবাইকে খাইয়ে এরপর রাজনের জন্য খাবার নিয়ে যায় সে।
হাসপাতাল পৌছে হাত ধুয়ে ভাত বাড়ে অন্তরা, রাজন বলে তুমি খাইয়ে দাও। অন্তরাও খুশি মনে খাইয়ে দিল, অনেকদিন পর পেট ভরে ভাত খেল রাজন। আজ অনেক খুশি অন্তরা, রাজনেরও মনটা অনেক ভালো। তারা বুঝতে পারলো এবার কিছুটা ইমপ্রোভ হচ্ছে রাজনের। রাত তখন ১১ টা, রবিন এসে দরজায় নক দিল, অন্তরা দরজা খুলতেই সে চট্টগ্রাম থেকে আসা ইঞ্জেকশান গুলো তাকে দেয় এবং বিদায় নেয়। নিশ্চিন্ত হলো অন্তরা। এরপর রাজনকে ওষূধ খাওয়ায় সে । রাজন ঘুমালে অন্তরাও শুয়ে পরে । এপাশ ওপাশ করে অন্তরা, কিন্তু ঘুমাসেনা, একেকটা ও্যষুধের অনেক দাম। এদিকে কোন ইনকাম নেয়, তবুও সকলের চিকিতসা , ওষুধ কেনা, বাজার খরচ সব কিছুর খেয়াল রাখছে সে। তবুও তার প্রিয় মানুষটাকে সুস্থ করানোর চিন্তা, আরো কত কি। কিন্তু নিজের কোন চিন্তার এতটুকু আচও সে লাগতে দেয়না রাজনকে। এভাবে আরো একটি রাত পার করে তারা।
পরদিন সকালে খুব ভোরে ঘুম ভাঙে রাজনের, সাথে অন্তরাও জেগে যায়। হাত মুখ ধুয়ে রাজন বলে, আমার অনেক ক্ষুধা পেয়েছে। শুনে অন্তরা খুশি হয়ে কেটলিতে রঙ চা করে সেখানে রাখা বিস্কুট খেতে দেয় রাজনকে। এতদিন তো রাজন কিছুই খেতে চায়নি, তাই ফল আর বিস্কিট ছাড়া অন্য কিছু ছিলনা। অন্তরা রাজনকে চা- বিস্কুট খাইয়ে নেবার পর নার্স আসে এবং যথারীতি রাজনকে ইঞ্জেকশান ও স্যালাইন দেয়। এরপর অন্তরা রাজনকে বলে তুমি থাকো, তোমার স্যালাইন শেষ হবার আগেই আমি নাস্তা বানিয়ে আনবো । রাজন বলে আচ্ছা, তুমি ভেবোনা আস্তে আস্তে যাও। নিজের খেয়ালও তো রাখতে হবে নাকি। একটু হেসে বেড়িয়ে পরে অন্তরা। এলাকার কাছে এলেই তার মনটা খারাপ হয়ে যায় , কিন্তু হয়তো এটাই দেখার বাকি ছিল ভেবে ঘরে যায় অন্তরা। বর আপা বারান্দায় বসে ছিল, বললো, ‘রাজনের এখন কি অবস্থা ? অন্তরা বলে, আপা আপনার ভাই তো আজ সকাল সকাল বলছে যে, তার নাকি ক্ষুধা লেগেছে। একথা শুনে খুশি আপা। কিন্তু আপার মুখটাও একেবারে শুকিয়ে গেছে, অন্তরা বুঝতে পারে তিনিও কষ্ট পাচ্ছেন। আপাকে ঘরে নিয়ে গরম চা আর ডিম পাউরুটি করে দেয় অন্তরা এবং সেগুলো খেয়ে নিতে বলে। মেয়ে আর ভাগ্নীও কাছেই ছিল। ভাগ্নীকে অন্তরা বুঝিয়ে দেয় যে, সে যেন তার মায়ের খুব যত্ন নেয়, আর ঠিক মত ওষুধ গুলো খাওয়ায়। এরপর নাস্তা রেডি করে আবার বেড়িয়ে পরে সে।
নাস্তা গুলো নিয়েই দেরি না করে রাজনকে খাওয়ায় সে। বলে দেখেছো তোমার স্যালাইন শেষ হবার আগেই চলে এসেছি। দেখতে দেখতে নয়টা বেজে গেল । কিছুক্ষণ পর ডাক্তার এলেন , অক্সিজেন অবস্থা মেপে দেখলেন, বললেন এখন কেমন লাগছে, খাওয়া দাওয়া করতে পারছেন? রাজনের আগেই অন্তরা বলে ফেলে যে , স্যার গত রাত থেকে ও খেতে চাইছে। ডাক্তার বললেন , আলহামদুলিল্লাহ, আর দু-তিন দিনের মধ্যেই আশা করি আপনারা বাড়ি ফিরতে পারবেন। এরপর আর কিছু পরামর্শ দিয়ে ডাক্তার সাহেব ভিজিট শেষ করলেন। এছাড়াও যত জন ডাক্তার ডিউটিতে থাকতেন তারা সবাই একবার হলেও দেখে যেতেন।
প্রতিদিনের ন্যায় অন্তরা যথারীতি খাবার তৈরি ও নিয়ে আসার জন্য বাসায় যায়, কখনো ভিজে, কখনো বা প্রচন্ড রোদে। বেশির ভাগ সময় পায়ে হেটেযেতে হয়, কারণ অল্প রাস্তা তাই কোন অটো যেতে যায় না। যদিও দু একজন পরিচিত ড্রাইভার ছিলেন যারা মাঝে মঝে অন্তরাকে দেখে নিজে থেকেই ডেকে পৌছে দিতেন। আর অন্তরার উপস্থিতি বা অনুপস্থিতে কতজন যে রাজনকে দেখতে যেত তা আর বলে শেষ করা যাবেনা। রাজনের অফিস সহকর্মীরা, বন্ধুরা অনেকেই আসে। সবার প্রার্থনা একটাই সুস্থহয়ে উঠুক রাজন।
এভাবে ৫ দিন পেরিয়ে ৬ দিনে পা দিলো । আজ ডাক্তার ভিজিটে এসে বললেন আরেকটা এক্সরে করাতে , রিপোর্ট ভালো হলে আজি রিলিজ দিতে পারেন। সকাল ১০ টার দিকে রাজনকে নিয়ে অন্তরা এক্সরে করাতে যায়। এক্সরে শেষে ডাক্তারকে রিপোর্ট দেখালে তিনি বলেন আরো দু’দিন থাকতে। একথা শুনে আবার তাদের মন খারাপ হয়ে যায়। যদিও এই সময় পুরো ট্রিটমেন্ট নেওয়াটাই জরুরি, নয়তো বা আবার সমস্যা হতে পারে, এবং এমন অনেকেই দ্বিতীয় বার এডমিট হয়েছিল বলেও ডাক্তার জানালেন। তাই কি আর করা , আরো দুদিন থাকার জন্য তারা মানসিক ভাবে প্রস্তুতি নিল। এদিকে কেবিন রুমে পৌছেয় অনেক রাগান্বিত হয় রাজন। কারন সে চায় বাসায় যেতে। প্রথমেই বলেছিলাম কোভিড আক্রান্ত রোগী খুব সহজেই রেগে যায়, মুখে যা আসে তাই বলে।রাজনও বলে আমার বাসায় যাবার দরকার নাই, আমি এখানেই থাকবো। প্রতিটি দিন যে কতটা যুদ্ধ করে কাটাচ্ছে অন্তরা সেটাই বা কে জানে। তারপরেও রাজনের এই অসুস্থ রাগ কে ভাঙ্গতে ওকে বোঝায় অন্তরা।
এভাবে হাসপাতালে আরো দুদিন কাটে রাজন ও অন্তরার। আটদিন হাসপাতালে থেকে ৯ম দিন সকালে রিলিজ পায় রাজন। আজ সে অনেক খুশি, গেল ক’দিনের মত এখন আর কাশি নেই, খেতেও পারছে স্বাভাবিক ভাবে। রিলিজ দেবার আগে ডাক্তার সাহেব কিছু নির্দেশনা ও মেডিসিন দেন। তিনি অন্তরাকে জানান যে ওনাকে কোন ভাবেই মানসিক ভাবে কস্ট দেওয়া যাবেনা। অনেক বেশি যত্নে রাখতে হবে, আর পুরোপুরি সুস্থ হতে কয়েকমাস লেগে যেতে পারে। এরপর সকল ফর্মালিটি শেষ করে রাজনকে নিয়ে ঘরে ফিরে অন্তরা, সাথে ছিলেন বড় দুলাভাই।
এবার ঘরে ফিরেই স্বস্তির শ্বাস নেয় রাজন। মেয়েকে অন্তরা আগেই বলে রাখে তার বাবার জন্য গরম পানি করতে, আর সেই পানি দিয়ে রাজনকে গোসল করিয়ে দেয় অন্তরা। আজ ,ভাই ঘরে আসবে বলে আপা অসুস্থ হলেও রান্না করেছেন , কারণ অন্তরাদের সব কাজ সেড়ে বাসায় ফিরিতে প্রায় ১.০০ টার মত বেজে গেছিল। এবার রাজন কলিজার টুকরো দুটোকে বুকে জড়িয়ে নেয় , ঠিক যেন অনেকদিন পর সে প্রাণ ফিরে পেল সন্তানদের কাছে পেয়ে। তারপর অন্তরা রাজনকে গরম গরম খেতে দেয়। আজ নিজের হাতে ,নিজের ঘরে আগের মত করে খাবার খায় রাজন। ঘরের প্রতিটি সদস্য অনেক খুশি। আর অন্তরা নিজের সকল কস্ট ভুলে গেছে স্বামীকে ঘরে ফিরিয়ে এনে। আল্লাহর কাছে শুকরিয়া জানায় সে।
এতকিছুর পরেও অন্তরা ভুলতে পারেনা স্বামীর সাথে ঘটে যাওয়া সেই করুন দিন গুলোর কথা, রাজনের পাওয়া কষ্ট গুলোর কথা, সমাজের মানুষগুলোর কথা, যারা সামনে অনেক ভালোবাসা দেখালেও তাদের মনের বাস্তব রুপটা দেখেছিল অন্তরা। অন্তরা ভাবে যে, বিপদেই বন্ধুর পরিচয় এই কথাটা কতটা খাটি। যাই হোক, রাজন ও অন্তরার জীবন আবার ধীরে ধীরে আগের মত চলতে শুরু করে। আপাও এখন সুস্থ। আপা, ভাগ্নী চলে যায় তাদের ঘরে। রাজন সহ সন্তানদের নিয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসে তারা। এখন অন্তরা পরিবারের প্রতি আরো অনেক বেশি যত্নশীল। রাজনও অন্তরাকে ছাড়া কোন কিছু ভাবতে পারেনা। সে বলে তোমার প্রচেষ্ঠার কারণেই আল্লাহ আমায় বাচিয়ে দিয়েছেন। অন্তরা –রাজনের বুকে মাথা রেখে বলে আমার পৃথিবী তুমি , আর সেই পৃইবীতে বেচে আছি আমার দুটো প্রাণ কে নিয়ে, তুমি ছাড়াতো আমি অচল। তাই আল্লাহ তোমাকে আমাদের মাঝে ফিরিয়ে দিয়েছেন।
ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী ১৫ দিন পর আবার রাজনকে এক্সরে করায় অন্তরা। এবার অন্তরা রিপোর্ট দেখাতে আসলে ডাক্তার বলেন, এখনো লাঞ্চ পুরোপুরি ভাল হয়নি এমনকি আরো মাসখানেক ওষূধ খেতে হবে বলে জানায় তিনি, তবে ডাক্তার বলেছেন রাজন সাহেবের প্রায় ৭০% এফেক্টেড হয়ে গেছিল, ওনাকে সবসময় টেক কেয়ার করবেন। আতংকিত স্ত্রী অন্তরা বলে এখন কোন ভয় নেই তো স্যার? জবাবে ডাক্তার বলেন , আল্লাহ ভররা এই ওষুধ গুলো নিয়মিত খেলে এবং আপনার পরিচর্যায় উনি সুস্থ হয়ে যাবেন।
অন্তরা –রাজনকে সম্পুর্ণ সুস্থ করতে পূর্ণ চেষ্টা চালিয়ে যায়। এখনো মাঝে মাঝে সে দিনগুলোর কথা মনে পরে অন্তরার। মনে পরে সেই মানুষ গুলোর কথা যারা তাদের অবহেলা করেছিল , আবার মনে পরে তাদের কথা যারা তাদের এই দুর্দিনে সবচেয়ে কাছে ছিল।
অন্তরা আজ জোড় গলায় বলতে চায় “ কখনো কোন রোগীকে অবহেলা করোনা, সে যেই রোগের রুগীই হোক না কেন, তাকে একটু সাহস দাও , কাছে না আসো অন্তত একটা ফোন করে হলেও খবর নিও, কারণ এই কাজ গুলোর কারণেই একটা রোগী অনেক ভাল হয়ে যেতে পারে। অন্তরা মন খুলে দোয়া করে সকলের জন্য যেন কেউ এমন কঠিন বিপদে না পরে।- লেখক: রুপা মল্লিক রুপু, সহকারি শিক্ষক,টি এন্ড টি গেইট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, খাগড়াছড়ি।

Read Previous

সাজেকে মাইক্রোবাস উল্টে পুলিশসহ ১২ পর্যটক আহত

Read Next

সভাপতির স্বাক্ষর জাল করে টাকা আত্মসাৎ: গোমতি বি.কে উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে অনিয়মের অভিযোগ