সংরক্ষিত বনাঞ্চল ও পাহাড় কেটে ‘সওজ’র সড়ক নির্মাণ

এম এস আকাশ, ফটিকছড়ি: সংরক্ষিত বনাঞ্চল, বন্যপ্রাণী অভয়াশ্রম ও পাহাড় কেটে সড়ক নির্মাণ করছে সড়ক ও জনপথ (সওজ) বিভাগ। ফটিকছড়ি-সীতাকুন্ড সংরক্ষিত বনাঞ্চলের ২১ কিলোমিটার সড়ক নির্মাণের জন্য দরপত্র আহবানও করেছে তারা। কিন্তু নেয়া হয়নি পরিবেশ ও বন বিভাগের ছাড়পত্র। এ সড়ক নির্মাণ হবে বনাঞ্চল-পরিবেশ ধ্বংস ও বিপন্ন হবে জীববৈচিত্র বলে বন ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা মন্তব্য করেছেন। উল্লেখ্য, বন ও পরিবেশ আইনে সংরক্ষিত বনাঞ্চলে রাস্তা বা প্রকল্প তৈরীর আগে সংশ্লিষ্ট দপ্তরের অনুমতিপত্র ও পরিবেশ ছাড়পত্র নেওয়া বাধ্যতামুলক।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, সড়ক ও জনপদ বিভাগ (সওজ) সম্প্রতি সীতাকুন্ডের বারৈয়াঢালা হয়ে ফটিকছড়ির হাজারীখীল পর্যন্ত ২১ কিলোমিটার দীর্ঘ বাইপাস সড়ক তৈরির জন্য প্রকল্প তৈরী, দরপত্র আহবান ও ঠিকাদার নিয়োগের কাজ ছুড়ান্ত করেছে। বরাদ্ধ চাওয়া হয়েছে ৫৬ কোটি টাকা। ২০১৯ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে এর কাজ শেষ হওয়ার কথা। সীতাকুন্ডের বারৈয়াঢালা থেকে ফটিকছড়ির হারুয়ালছড়ি ইউনিয়নের লম্বা বিল এই সড়কের মৌলিক অংশ হচ্ছে ফটিকছড়ি-সীতাকুন্ড সংরক্ষিত বনভূমি। অথচ এই সড়ক নির্মাণ প্রকল্প শুরুর আগে কোনো সমীক্ষা করা হয়নি। নেওয়া হয়নি সংশ্লিষ্ট কোন দপ্তরের অনাপত্তিপত্র। এ দিকে গত ১৪ আগস্ট বারৈয়াঢালা রেঞ্জের দক্ষিণাঞ্চলীয় সংরক্ষিত বনভূমি পেরিয়ে রামগড়-সীতাকুন্ড বনাঞ্চলের মধ্য দিয়ে এ সড়ক নির্মাণের জন্য জঙ্গল পরিস্কারের চেষ্টা চালায় সওজ। এ সময় বারৈয়াঢালার রেঞ্জ কর্মকর্তা ও বিট কর্মকর্তাসহ হাজারীখিল বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য এলাকার সিএমসি ও সিপিজি সদস্যরা কাজে বাঁধা দেন। এ ঘটনার পর চট্টগ্রাম উত্তর বন বিভাগের বিভাগীয় কর্মকর্তা সওজকে একটি চিঠি দিয়ে আপত্তির কথা জানান।
সংরক্ষিত বনাঞ্চল ও বন্যপ্রাণী অভয়াশ্রম:

চট্টগ্রাম উত্তর বন বিভাগের হাজারীখিল রেঞ্জের হাজারী খিল ও ফটিকছড়ি বিট এলাকায় বন বিভাগ ও ক্রেল’র সহযোগিতায় ২০১০ সালে ২ হাজার ৯ শত ৮ হেক্টর পাহাড়ী অঞ্চলে সরকরী ভাবে গড়ে উঠছে বন্যপ্রাণী অভায়রণ্য। এখানে ২শত ৫০ প্রজাতির গাছ ও ১ শত ৫০ প্রজাতির পাখি রয়েছে বলে বন ও বন্যপ্রাণী বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছে। বাংলাদশেরে বিরল প্রজাতির বৈলাম গাছ রয়েছে এই বনে। যার উচ্চতা হলো প্রায় ১০০ মিটার যা বাংলাদেশে সবচেয়ে উচু বৃক্ষ হিসেবে পরিচিতি। এই গাছ বাংলাদেশরে অন্য কোথাও দেখা যায় না । আর বন্য প্রাণীর মধ্যে রয়েছে ”বন ছাগল” নামক বিরল প্রজাতীর আরেক প্রাণী। যা এই অঞ্চলে অভয়ারন্য ঘোষনার পর ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে বলে জানিয়েছে হাজারীখিল বন কর্মকর্তা মো. কাউছার হোসেন। এ ছাড়া হাজারীখীল বনে বনকুকুর, বনমুরগী, তক্ষক, গরিগীটি, মুখপোড়া হনুমান, বানর, গুইসাপ, বড় অজগর, হরিণ, মেছোবাঘ, বন্যশূকর রয়েছে প্রচুর। উল্লেখ যোগ্য বৃক্ষ হল সেগুন, র্গজন, গামারী, চাপালশি, তলেসুর, জারুল, লোহাকাঠ, ছাতীয়ান, গুটগুট্টা, লটকন। পাখরি মধ্যে রয়েছে মথুরা, শালিক, ঘুঘু, চড়ুই, টিয়া, বক, দোয়েল, ময়না রয়েছে বলেও জানান। প্রাকৃতকি সম্পদ ব্যবস্থাপনা ও জীববৈচিত্র রক্ষার গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদশে সরকাররে বন, পরবিশে ও মৎস্য অধিদপ্তররে যৌথ উদ্যোগে ইউএসএইডের আর্থিক সহযোগতিায় ২৭ নভম্বের ২০১৪ সালে হাজারীখীল বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্যে সহ-ব্যবস্থাপনা কমিিট (সিএমসি) গঠন করা হয়। দুইটি বনবিটে ২১ সদস্য বিশিষ্ট মোট ৪২ জন সিপিজি সদস্য সর্বদা বন রক্ষায় কাজ করছে বলে জানিয়েছে সিএমসি সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন।

ন্যাচারাল ইকো-টুরিজম পোগ্রাম কো-অডিনেটর অপু নজরুল বলেন, সীতাকুন্ড-ফটিকছড়ির বন-জঙ্গল-ঝর্না আমার দীর্ঘ দিনের চেনা অঞ্চল। এই সব পাহাড়ী অঞ্চলের মানুষ এক সময় বন জঙ্গল থেকে গাছ কাটতো, লাকড়ী করে বিক্রি করতো। ২০১০ সালে হাজারীখীল বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য ঘোষনার সহ-ব্যবস্থাপনা সমিতির মাধ্যমে তারা বিকল্প জীবিকায়ণে ফিরে গেছে। এরপর থেকে এখানে প্রচুর সাপ-ব্যঙ্গ-বিচ্ছু, বন ছাগল, বন মোরগ, হরিণ, মেচো বাগের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। এই বনে সড়ক নির্মাণ যেমন পরিবেশের ক্ষতি হবে, তেমনি উপজাতি পাড়া গুলো থেকে সমতলে অবাধে বাংলা মদ পাচার বৃদ্ধি পাবে। পরিবেশ ও সমাজের স্বার্থে এই সড়ক নির্মাণ বন্ধ রাখা জ¦রুরী।
বাংলাদেশ ফেড়ারেশ সাংবাদিক ইউনিয়ন (বিএফইউজে) কেন্দ্রীয় যুগ্ন সম্পাদক সাংবাদিক মুহসীন কাজী। তিনি হারুয়ালছড়ি গ্রামের বাসিন্ধা। তিনি বলেন, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহা সড়কের বাইপাস সড়ক হিসেবে হাটহাজারীর বড়দিঘীর পাড় থেকে সীতাকুন্ডের ভাটিয়ারী এবং ফটিকছড়ির নারায়ণহাট হতে শ্বেতছড়া হয়ে মীরশ্বরাই সদর পর্যন্ত দুইটি সড়ক তৈরী করা হয়েছে। এই সড়ক গুলোর উপকারিতা কতটুকু কাজে আসছে? তা আগে পর্যবেক্ষণ করা দরকার। শ্বেতছড়া-মীরশ্বরাই সড়কে অহরহ সরকারী বনাঞ্চলের কাঠ চুরি, পাচার ও ছোরাই কাঠ আটকের খবর হরহামেশাই পত্র পত্রিকায় আসছে। এখানে যদি সড়ক নির্মাণ হয়, নষ্ঠ হবে শত শত বছরের সীতাকুন্ড-ফটিকছড়ি সংরক্ষিত বনাঞ্চল এবং ২০১০ সাল বন অধিদপ্তরের শত শত কোটি টাকা ব্যয় করে গড়ে তোলা বন্যপ্রাণী অভয়াশ্রমের। যা পরিবেশের জন্য মোটেও শুভ নয়।
সড়ক ও জনপদ বিভাগের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী রবিউল হোসেন বারৈয়ারঢালা এলাকায় সড়ক নির্মাণের প্রাথমিক কাজ করতে গিয়ে বন বিভাগের বাঁধা প্রাপ্ত হওয়ার কথা স্বীকার করে বলেন, বন বিভাগের লোকজনের সাথেতো আমরা মারা মারি করে সড়ক নির্মাণ করবোনা। তাই আমরা এ ব্যাপারে মন্ত্রনালয় থেকে মন্ত্রনালয়ে অনুমতির বিষয় জানিয়ে সংশ্লিষ্ট উদ্বর্তন কর্তৃপক্ষের কাছে চিঠি লিখেছি।

এ ব্যাপারে চট্টগ্রাম উত্তর বন বিভাগের বিভাগীয় কর্মকর্তা বখতেয়ার নূর সিদ্দিকী জানান, সংরক্ষিত বনের ভেতর রাস্তা নির্মাণে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের বিধি নিষেধ রয়েছে। বাংলাদেশে কয়েকটি সংরক্ষিত বনাঞ্চলের মধ্যে সীতাকুন্ড-ফটিকছড়ির সংরক্ষিত বনাঞ্চল তথা হাজারীখীল বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য একটি। সড়ক ও জনপদ বিভাগ এই বনাঞ্চলের ভিতর দিয়ে সড়ক নির্মাণের জন্য কাজ শুরু করেছে সেজন্য বন বিভাগ কোনো অনাপত্তিপত্র নেয়নি। এজন্য আমরা বাঁধা দিয়েছি। এ বিষয়ে আপত্তি জানিয়ে বন অধিদপ্তর এবং সড়ক ও জনপদ বিভাগে একাধিক পত্র প্রেরণ করা হয়েছে।

পাহাড়ের আলো

https://pahareralo.com

সর্বাধিক জনপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল। সর্বশেষ সংবাদ সবার আগে জানতে চোখ রাখুন পাহাড়ের আলোতে।

Related post