পাহাড়ে ৯ মাসে ৩৫ খুন

স্টাফ রিপোর্টার: তিন পার্বত্য জেলায় আঞ্চলিক দলের সন্ত্রাস-খুনোখুনি-অপহরণ আর চাঁদাবাজির জেলা হিসেবে খাগড়াছড়ির দুর্নাম অনেক পুরনো। আঞ্চলিক দলের আধিপত্য বিস্তার আর সশস্ত্র শাখার নিরাপদ প্রশিক্ষণ এবং কালেক্টর নিয়োগের প্রয়োজনে এটি সংক্রমিত হয়েছে পাশের জেলা রাঙামাটির দুটি উপজেলাতেও। এরমধ্যে নানিয়ারচর থেকেই আলোচিত সংগঠন ‘গণতান্ত্রিক ইউপিডিএফ’র জন্ম হয়েছে গত বছরের নভেম্বরে। আর তখন থেকেই খাগড়াছড়ির সাত উপজেলা আর রাঙামাটির এই দুই উপজেলায় চলছে রক্তক্ষয়ী হত্যাকাণ্ড। খাগড়াছড়ির পাহাড়িদের মধ্যে বিশেষ করে চাকমা সম্প্রদায় অধ্যুষিত এলাকাগুলোতেই আঞ্চলিক দলের সশস্ত্র তৎপরতা বেশি লক্ষ্য করা যায়। দুই জেলার সাত উপজেলায় গত বছরের ডিসেম্বর থেকে এখন পর্যন্ত ৩৫ জন খুন হয়েছেন বুলেটের আঘাতে। আঞ্চলিক দলগুলোর পক্ষ থেকে দেয়া পরিসংখ্যানে মৃত্যুর সংখ্যা আরো বেশি। পার্বত্য শান্তিচুক্তির আগে ও পরে টার্গেট কিলিংয়ের ক্ষেত্রে যাতে নিরীহ এবং অরাজনৈতিক মানুষ মারা না যান সেটি কিলার’রা মাথায় রাখতো। কিন’ ইদানিংকালের ঘটনাগুলোতে ভারী অস্ত্রের ব্যবহার এবং ব্রাশ ফায়ারের ফলে টার্গেটের কাছে থাকা সাধারণ ও নিরীহ পাহাড়িদেরও প্রাণ দিতে হচ্ছে। এরমধ্যে গতকাল শনিবার খাগড়াছড়ি শহরের স্বনির্ভর এবং পেরাছড়া হামলায় নিহত সাত জনের মধ্যে চার জনই নিরীহ। এছাড়া প্রতিনিয়ত কোথাও না কোথাও পাহাড়িরা আঞ্চলিক দলের দুর্বৃত্তদের হাতে নানাভাবে নাজেহালের শিকার হচ্ছেন। একের পর এক হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় পাহাড়ে বইছে যেনো লাশের মিছিল।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত বছরের নভেম্বর মাসের মাঝামাঝিতে প্রসিত বিকাশ খীসার নেতৃত্বাধীন ‘ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ)’-এর সশস্ত্র শাখার প্রধান এবং নানিয়ারচর উপজেলার দাপটশালী কমাণ্ডার তপন জ্যোতি চাকমা ওরফে বর্মার নেতৃত্বে ‘ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক)’ নামে আরেকটি দলের আত্মপ্রকাশ ঘটলেই অসি’র হয়ে উঠে খাগড়াছড়ি জেলা এবং রাঙামাটির দুটি উপজেলা। এসব উপজেলায় আগে সংস্কারপনি’ ‘জনসংহতি সমিতি এবং’ ‘ইউপিডিএফ’-এর মধ্যকার সম্পর্ক ভালোই ছিল। ইউপিডিএফ থেকে ২০১৩ সালে বহিষ্কৃত তপন জ্যোতি চাকমা প্রকাশ বর্মা ইউপিডিএফ-এর সামরিক কমান্ডার থাকাকালীন সময়ে পার্বত্য এলাকায় বিশেষত নানিয়াচরসহ রাঙামাটি এবং খাগড়াছড়িতে ব্যাপক আধিপত্য গড়ে তুলেছিল। দল থেকে বহিষ্কৃত হওয়ার দীর্ঘদিন পর তপন জ্যোতি চাকমা ২০১৭ সালে নতুন দল নিয়ে মাঠে নামলেই পরিসি’তি ঘোলাটে হতে থাকে।

২০১৪ সালের জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগ পর্যন্ত খাগড়াছড়িসহ অন্যান্য এলাকায় সংস্কারপনি’ জনসংহতির সাথে ইউপিডিএফ-এর দৃশ্যত কোন ঝামেলা ছিল না। কিন’ ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে দুই দলের দুই প্রার্থী মাঠে নামলেও সংঘাত হয়নি। সেই নির্বাচনের পরে উপজেলা পরিষদের নির্বাচনেও এই দুটি দল ভাগাভাগির ভিত্তিতে জনপ্রতিনিধি নির্বাচন করেছে। কিন’ বহিষ্কৃত বর্মাকে দল গঠনে আস্কারা প্রদানের সন্দেহ থেকে প্রথমে দুই দলের সশস্ত্র শাখার মধ্যে পাল্টাপাল্টি আক্রমণ এবং পরে তা ক্রমে রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের মাঝেও ছড়িয়ে পড়ে।

ইউপিডিএফ’র সূত্রে জানা যায়, ২০১৭ সালের নভেম্বর থেকে চলতি আগস্ট পর্যন্ত মূল সংগঠন এবং সহযোগী সংগঠনের ২০ জন নেতাকর্মী ও সমর্থক খুন হয়েছেন। গত বছরের ডিসেম্বর মাসেই রাঙামাটির নানিয়াচর উপজেলায় ইউপিডিএফ-এর দুই কর্মী ও সমর্থক সাবেক ইউপি সদস্য অনাদি রঞ্জন চাকমা ও অনিল বিকাশ চাকমা খুন হন। এই হত্যকাণ্ডের রেশ না কাটতেই জানুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহে খাগড়াছড়ি জেলা সদরের নিজ বাড়ির সামনে থেকে তুলে নিয়ে খুন করা হয় মিঠুন চাকমাকে। পিসিপি ও গণতান্ত্রিক যুব ফোরামের সাবেক এই কেন্দ্রীয় সভাপতি ইউপিডিএফ’র অন্যতম শক্তিশালী-জনপ্রিয় নেতা ছিলেন। কেন্দ্রীয় সভাপতি ও দলীয় শীর্ষস’ানীয় নেতাদের মধ্যে অন্যতম। এই ঘটনার এক মাস বিরতিতে ১৭ ফেরুয়ারি খাগড়াছড়ি জেলা সদরের রাঙাপানি ছড়ায় দীলিপ চাকমা খুন হন। এই ঘটনার তিন দিন পর জেলার দীঘিনালা উপজেলার জামতলীতে গুলি করে সাইন চাকমা সুপারা নামে এক ইউপিডিএফ কর্মীকে হত্যা করা হয়। মার্চ মাসে খাগড়াছড়ি সীমান্তবর্তী উপজেলা বাঘাইছড়িতে নতুন মনি চাকমা নামে আরেক কর্মী খুন হন। এপ্রিল মাসে খাগড়াছড়ি জেলা সদরের কমলছড়িতে সূর্য বিকাশ চাকমা (৪৫) নামে এক সমাজ কর্মী নিহত হন। নিজেদের নেতা বা কর্মী না হওয়া সত্ত্বেও ইউপিডিএফ তাঁর মৃত্যুর পর প্রতিবাদে খাগড়াছড়িতে বিক্ষোভ মিছিল করেছে। একই সপ্তাহে খাগড়াছড়ির পানছড়িতে খুন হন ইউপিডিএফ সংগঠক নতুন কুমার ত্রিপুরা (৪০)। ২২ মে খাগড়াছড়ির দীঘিনালায় উজ্জ্বল কান্তি চাকমা ওরফে মার্শাল (৫৫) নামে আরো এক সাবেক কর্মী প্রতিপক্ষের হাতে প্রাণ হারান। এছাড়া খাগড়াছড়ি থেকে দীঘিনালায় নিজ বাড়িতে ফেরার পথে জেরান চাকমা নামের সাবেক এক পিসিপি কর্মীকে দীঘিনালা বাস স্টেশন থেকে প্রকাশ্যে তুলে নিয়ে যায় দুর্বৃত্তরা। সেই থেকে এখনো নিখোঁজ জেরান।

এদিকে ২৮ মে রাঙামাটির বাঘাইছড়িতে সঞ্জীব চাকমা (৩০), অতল চাকমা (৩০) ও স্মৃতি চাকমা (৫০)কে ব্রাশ ফায়ার করে খুন করা হয়। একাধিক ঘটনায় নানিয়াচর, বাঘাইছড়ি ও পানছড়িতে কিরণ চাকমা, জনি তঙ্গগ্যা ও সুনীল বিকাশ চাকমা নামে তিন ইউপিডিএফ কর্মী খুন হন। এছাড়া হিল উইমেন্স ফেডারেশনের দুই নেত্রী অপহরণের দীর্ঘ সময় পর মুক্তি পায়। ঘটনাটি দেশে-বিদেশে রীতিমতো আলোড়ন সৃষ্টি করে। গত সপ্তাহে দীঘিনালা উপজেলা সদরে অজ্ঞাত দুর্বৃত্তদের হাতে প্রাণ হারান মঞ্জুরুল ইসলাম মঞ্জু নামের ইউপিডিএফ’র সাবেক এক কালেক্টর।

এসব হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি- জেএসএস-(এম এন লারমা) ও গণতান্ত্রিক ইউপিডিএফকে দায়ী করেছে প্রসীত খীসার নেতৃত্বাধীন ইউপিডিএফ। অভিযোগ অস্বীকার করে জেএসএস (এমএন লারমা) কেন্দ্র তথ্য ও প্রচার সম্পাদক সুধাকর ত্রিপুরা জানান ,‘ ইউপিডিএফ এর অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের কারণেই এসব হত্যাকাণ্ড ঘটেছে।

অপরদিকে একই সময়ে খাগড়াছড়িসহ নানিয়ারচর ও বাঘাইছড়িতে পাল্টা হামলায় জেএসএস (এমএন লারমা) এর শীর্ষ ও ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) দলীয় প্রধানসহ ১১ জন মারা যান । গত ৩ মে রাঙামাটির নানিয়াচর উপজেলা চেয়ারম্যান ও জেএসএস (এমএন লারমা) কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি অ্যাডভোকেট শক্তিমান চাকমা খুন হন। শক্তিমান চাকমা ছিল দলটির অন্যতম প্রধান নেতা। শক্তিমানের নানামুখী যোগ্যতার ফলে ক্ষমতাসীন সরকারের নীতি-নির্ধারকদের সাথেও যোগাযোগ গড়ে উঠেছিল জনসংহতি সমিতির এই অংশের সাথেও। কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাবেক এই নেতা খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটি আসনের নির্বাচনে ফ্যাক্টর হয়ে উঠেছিলেন। এ ঘটনার দুই দিনের মাথায় শক্তিমান চাকমার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় যোগ দিতে গিয়ে পথিমধ্যে কমান্ডো হামলায় ঘটনাস’লেই প্রাণ হারান গণতান্ত্রিক ইউপিডিএফ এর প্রধান তপন জ্যোতি চাকমা (বর্মা)সহ ৬ জন। এরমধ্যে বর্মা ছাড়া দুইজন জনসংহতি সমিতির ছাত্র ও যুব কর্মী। এবং বাকিরা সাধারণ সমর্থক বলে জানা গেছে।

গত জুন ও জুলাইয়ে সুরেশ বিকাশ চাকমা, জঙ্গলী চাকমা, পঞ্চানন চাকমা, বিজয় কুমার চাকমা, শান্তি রঞ্জন চাকমা নামে এক জেএসএস কর্মীকে গুলি ও জবাই করে হত্যা করা হয়। হত্যাকাণ্ডের জন্য ইউপিডিএফ (প্রসীত)কে দায়ী করেছিল জেএসএস (এমএন লারমা)। সর্বশেষ ২৬ জুলাই রাঙামাটির বাঘাইছড়িতে খুন হন বন কুসুম চাকমা (৩০)। তিনি জেএসএস (এমএনলারমা) অংশের কর্মী বলে জানা যায়।
জনসংহতি সমিতি (এম এন লারমা) অংশের রাজনৈতিক শাখা থেকে জানানো হয়েছে, চলতি বছরের এপ্রিল থেকেই ইউপিডিএফ’র সাথে তাদের সশস্ত্র সংঘাত শুরু হয়েছে। তখন থেকে এই পর্যন্ত দলটির ১২ জন নেতাকর্মী প্রাণ হারানোর পাশাপাশি আহত হয়েছেন পাঁচ নেতাকর্মী।

খাগড়াছড়ি জেলা আওয়ামী লীগ নেতা নির্মলেন্দু চৌধুরী মনে করেন, অবৈধ অস্ত্রের কারণেই একের পর এক প্রাণহানি ঘটছে। অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে কঠোর পদক্ষেপ নেয়া হলে পরিসি’তি স্বাভাবিক থাকবে।
তিনি আঞ্চলিক দলগুলোকে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে হত্যা-সংঘাত ও চাঁদাবাজি বন্ধ করে সরকারের চলমান  উন্নয়নে সম্পৃক্ত হবারও আহ্বান জানান।

‘সুশাসনের জন্য প্রচারাভিযান (সুপ্র)-খাগড়াছড়ি জেলা শাখার সভাপতি ও নারীনেত্রী নমিতা চাকমা বিগত ছয় মাসে খুনোখুনি বেড়ে যাওয়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, জেলা ও উপজেলা শহরে দিনে-দুপুরে জনপ্রতিনিধি-ছাত্র-যুবকদের প্রাণহানির ঘটনাই আমরা শঙ্কিত। সাধারণ নিরীহ মানুষও হত্যার শিকার হচ্ছে। পাহাড়ে জান-মালের নিরাপত্তা বিধান করা সরকারের পক্ষেই সম্ভব। সরকার ইচ্ছে করলেই এসব গুরুতর অপরাধ বন্ধ করতে পারে। আর যদি এটিকে পাহাড়িদের অভ্যন্তরীণ সমস্যা বলে এড়িয়ে যাওয়া হয়, তাহলে তা কারোর জন্য মঙ্গল বয়ে আনবে না।

‘সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)’ খাগড়াছড়ি জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক ্অ্যাডভোকেট নাসির উদ্দিন আহমেদ বলেন, কোন অস্বাভাবিক মৃত্যু কাম্য নয়। কিন’ পাহাড়ে প্রতিনিয়ত হত্যা বেড়েই চলেছে। একের পর এক সংঘটিত হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠু-নিরপেক্ষ তদন্তের মাধ্যমে অপরাধীদের চিহ্নিত করা হচ্ছে না বলেই সন্ত্রাসের প্রবণতা বাড়ছে। প্রশাসনের উচিত এই শ্বাসরুদ্ধকর এবং অনিরাপদ অবস’ার উত্তরণের পথ খুঁজে বের করা।

খাগড়াছড়ির পুলিশ সুপার আলী আহমদ বলেন, যৌথ বাহিনীর নেতৃত্বে তল্লাশি পরিচালনা করা হবে। অবৈধ অস্ত্রধারী অপরাধীরা জনগণের মাঝেই লুকিয়ে আছে। আমরা গোপন সূত্র ব্যবহার করে সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস’া নেবো।

Read Previous

লামায় ঈদুল আযহা উপলক্ষে ভিজিএফ’র চাল বিতরণ

Read Next

স্বনির্ভরের ঘটনায় শন কুমার চাকমার মৃত্যু হয় ব্রিজ থেকে পড়ে